জাতিসংঘের ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ প্রতিবেদন: দায়বদ্ধতার প্রয়াস, নাকি রাজনৈতিক হাতিয়ার?
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের দপ্তর (OHCHR) যখন বাংলাদেশের জুলাই–আগস্ট ২০২৪ সালের আন্দোলন নিয়ে তাদের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন—এটা হয়তো দায়বদ্ধতার পথে বড় এক পদক্ষেপ। প্রতিবেদনটি আওয়ামী লীগ সরকার আর তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে দমনপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা আর গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। কিন্তু এই প্রতিবেদনটা পড়ে মনে হয়—এটার পেছনের অনুসন্ধান কতটা স্বচ্ছ বা নিরপেক্ষ, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময় প্রকাশিত এই নথি কি সত্যিই স্বাধীনভাবে তৈরি, নাকি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মজবুত করার জন্যই বানানো—সেই সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অনুসন্ধানের শুরুতেই পক্ষপাতের ছাপ প্রতিবেদনটি শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ সরকারকে মূল দায়ী পক্ষ হিসেবে দেখিয়েছে। বলা হয়েছে, “যথেষ্ট কারণ আছে মনে করার যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো পরিকল্পিতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে।” (UNOG Newsroom, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) কিন্তু এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি অস্পষ্ট। কার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, কীভাবে সাক্ষ্য যাচাই করা হয়েছে, সেনা, পুলিশ বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে কিনা—কোনোটাই বলা নেই। এমনকি জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের অনুমোদন ছিল কিনা, তাও জানা যায় না। ফলে প্রশ্ন উঠছে—এটা কি জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক মিশন, নাকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রভাবিত উদ্যোগ? যে কোনো সরকারকে “পদ্ধতিগত নির্যাতনের” দায়ে অভিযুক্ত করতে হলে প্রমাণের মান হওয়া উচিত সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ের। কিন্তু এই প্রতিবেদন তার কাছাকাছিও যায়নি। অনুসন্ধানের ভিত্তি না দেখিয়েই অভিযোগগুলোকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে করে পুরো ব্যাপারটা নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের চেয়ে রাজনৈতিক গল্পের মতো মনে হয়। বেছে নেওয়া সাক্ষ্য আর একপেশে বয়ান OHCHR বলেছে তারা ২৫০ জনেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে, হাজার হাজার প্রমাণ দেখেছে। কিন্তু কারা ছিলেন এরা—ভুক্তভোগী, প্রত্যক্ষদর্শী না সরকারি কর্মকর্তা—তা বলা হয়নি। ফলে পুরো চিত্রটা একপেশে থেকে গেছে। আরেকটি বড় সমস্যা হলো—অভিযুক্তদের বক্তব্য একবারও নেওয়া হয়নি। শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভা, বা পুলিশ প্রধানদের কাছ থেকে কোনো জবাব নেওয়া হয়নি। তাই প্রতিবেদনটি অনেকটা একপক্ষের অভিযোগপত্রের মতো লাগে। বিচার মানে দুই পক্ষের কথা শোনা—OHCHR সেই সুযোগ দেয়নি। ৫ আগস্টের ঘটনা আর দায়ের প্রশ্ন প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার নির্দেশেই ৫ আগস্ট ব্যাপক গুলি ও সহিংসতা চালানো হয়। কিন্তু তিনি তো ওইদিন সকালে দেশ ছাড়েন—যে সময়ের পরেই বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, যখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ তখন আর তাঁর হাতে ছিল না, তখন কীভাবে দায় শুধু তাঁর সরকারের ওপর বর্তায়? এই সময়রেখা গুলিয়ে ফেলায় ঘটনাগুলোর বাস্তব প্রেক্ষাপটই বদলে গেছে। এতে করে পুরো দোষ একপক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া সহজ হয়ে গেছে। তদন্তকারীদের নাম-পরিচয় নেই জাতিসংঘের অন্য তদন্ত কমিশনের মতো এখানে তদন্ত দলের সদস্যদের নাম বা যোগ্যতা কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। মানুষ জানেই না কারা এই প্রতিবেদন লিখেছে, তারা কীভাবে বাছাই হয়েছে, বা তাদের আগের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা যা নিরপেক্ষতাকে প্রভাবিত করতে পারে। স্বচ্ছতা না থাকলে বিশ্বাসযোগ্যতাও থাকে না। এই বেনামি দলটিই অনেকের চোখে প্রতিবেদনের নিরপেক্ষতাকে সন্দেহজনক করে তুলেছে। সংখ্যার গরমিল আর সংশোধনের অভাব প্রতিবেদন বলছে আন্দোলনে ১,৪০০ জন পর্যন্ত নিহত হয়েছে (UN Bangladesh, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। কিন্তু স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক রিপোর্টে সংখ্যায় অনেক অমিল আছে। AFP–এর এক ফ্যাক্টচেকে (১৪ আগস্ট ২০২৪) দেখা যায়, এক বাংলা দৈনিক প্রথমে ২০১ জনের মৃত্যুর কথা বললেও যাচাই শেষে সেটি ১৯৩–এ নেমে আসে। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে আসে, কিছু মৃত্যুর সঙ্গে আন্দোলনের কোনো সম্পর্কই ছিল না—জমি নিয়ে ঝামেলা বা দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া লোকজনকেও “শহিদ তালিকায়” ঢোকানো হয়েছিল। এমনকি যাদের মৃত বলা হয়েছিল, তাদের কেউ কেউ পরে জীবিত অবস্থায় ফিরে আসেন। এইসব তথ্য বেরিয়ে আসার পরও OHCHR সংখ্যা সংশোধন করেনি। এতে পুরো প্রতিবেদনটির তথ্যভিত্তিক বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। মনে হয় সংখ্যাগুলো এমনই রাখা হয়েছে, যাতে কাঙ্ক্ষিত গল্পটা ঠিক থাকে। ফরেনসিক তথ্য উপেক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক মৃত্যু ৭.৬২ মিমি গুলিতে হয়েছে, কিন্তু পুলিশ বলছে তারা এই ধরনের গুলি ব্যবহারই করে না। অনেক ঘটনা এমন জায়গায় ঘটেছে যেখানে পুলিশ ছিল না, আবার কেউ কেউ ঘরের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এই অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলেও কোনো বিশ্লেষণ বা যাচাই করা হয়নি। এতে বোঝা যায়—কোনো তথ্য হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এমন হলে অনুসন্ধানের বিশ্বাসযোগ্যতা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে এমন ফরেনসিক ঘাটতি একেবারে অগ্রহণযোগ্য। প্রতিবেদন নয়, এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, এই প্রতিবেদনটি কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, এটি কোনো আইনি অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না (The Daily Star, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)। তবুও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় এই প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করা হচ্ছে। ফলে, মানবাধিকার রক্ষার জন্য করা এক প্রতিবেদনই এখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। এটি এক বিপজ্জনক নজির তৈরি করছে—যেখানে “ন্যায়বিচার” নয়, “রাজনীতি”ই জিতে যাচ্ছে। দায়বদ্ধতার জন্য সত্য ও স্বচ্ছতা জরুরি জুলাই–আগস্ট ২০২৪–এর সহিংসতা যে ভয়াবহ ছিল, তা কেউ অস্বীকার করে না। অনেক নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, দেশজুড়ে ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু কেবল নৈতিক ক্ষোভ বা আবেগ দিয়ে সত্য পাওয়া যায় না। প্রয়োজন নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও প্রমাণভিত্তিক তদন্ত। বাংলাদেশে যদি সত্যিকারের দায়বদ্ধতা চাওয়া হয়, তাহলে নতুন এক আন্তর্জাতিক তদন্ত দরকার—যেখানে সব পক্ষের বক্তব্য শোনা হবে, প্রতিটি মৃত্যুর যাচাই হবে, আর রাজনৈতিক প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকবে। এর আগে পর্যন্ত OHCHR–এর প্রতিবেদনটি ন্যায়বিচারের নয়, বরং সতর্কবার্তা হিসেবেই থাকবে—যে, মানবাধিকারকে যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, তাহলে হারিয়ে যায় ন্যায়বিচারও, আর ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিশ্বাসযোগ্যতাও। সূত্র: The UN ‘Fact Finding’ Report On Bangladesh’s 2024 Protests: Accountability Or Political Instrument? – OpEd United Nations Bangladesh (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) UNOG Newsroom (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) The Daily Star (ফেব্রুয়ারি ২০২৫) bdnews24.com (ফেব্রুয়ারি ২০২৫) প্রথম আলো (২০২৪) AFP Fact Check (১৪ আগস্ট ২০২৪) The Business Standard (২০২৪)
