কারাগারে চিকিৎসাবঞ্চিত অসুস্থ লীগ নেতাকর্মীদের ‘অসুস্থ নয়’ লিখিয়ে নিচ্ছে পুলিশ: জানাল পরিবার

৩০ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

গ্রেপ্তারের পর অসুস্থ হয়ে পড়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বহু নেতাকর্মী এখন কারাগারে কিংবা রিমান্ডের পর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগও পাচ্ছেন না—এমন অভিযোগে সরব তাদের পরিবার ও আইনজীবীরা। আরও গুরুতর অভিযোগ—পুলিশ বা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চিকিৎসকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন যেন তারা মেডিকেল রিপোর্টে “রোগী অসুস্থ নয়” বা “তাৎক্ষণিক ভর্তি প্রয়োজন নেই” লিখে দেন। এমনকি বেশ কয়েকজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে বিডিডাইজেস্ট-এর অনুসন্ধানী দলের কাছে আসা সাক্ষ্য, পরিবার–সাক্ষাৎকার, স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতিবেদন ও মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা এক ধরনের “প্রশাসনিক অস্বীকার নীতি”র ইঙ্গিত দিচ্ছে—যেখানে অসুস্থ কারাবন্দীর শারীরিক অবস্থার বাস্তবতা লিখে রাখতেও চিকিৎসকরা স্বাধীন নন। সর্বশেষ মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু জেলা কারাগারে মারা গেছেন। ৮০ বছর বয়সী বাচ্চুকে জুলাই ষড়যন্ত্রের সময় এনায়েতপুর থানায় হামলা ও ১৫ পুলিশ হত্যা মামলাসহ চারটি মিথ্যা হত্যা মামলার আসামি করা হয়। অথচ তিনি ছিলেন হার্ট, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এর আগে ৫ই আগস্ট ২০২৪ থেকে অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন কারাগারে প্রায় অর্ধশত নেতাকর্মী মৃত্যুবরণ করেছেন। কিছু ঘটনা উল্লেখ করা হলো: গোপালগঞ্জের এলাহী শিকদার (১৯) ৩রা সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হওয়ার একদিন পর ৭ই সেপ্টেম্বর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান; পরিবার তার মৃত্যুকে নির্যাতনের ফল হিসেবে উল্লেখ করেছে। একই জেলা থেকে আলিমুজ্জামান চৌধুরী (৫৮) ১৫ই সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১৪ই অক্টোবর স্ট্রোকের কারণে মারা যান, পরিবার তারও মৃত্যুকে নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেছে। গাইবান্ধার শফিকুল ইসলাম (৪৫) এবং সোহরাব হোসেন অ্যাপল (৩৫) ৯ই সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে পরদিন মৃত্যুবরণ করেন; পরিবারের মতে তাদের মৃত্যু নির্যাতনের ফল। বগুড়া জেলার শহিদুল ইসলাম রতন (৫৮) ৪ঠা অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে ১১ই নভেম্বর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান এবং অপচিকিৎসার অভিযোগ করা হয়েছে। একই জেলার আব্দুল লতিফ (৬৭) ১৫ই আগস্ট গ্রেপ্তার হয়ে ২৫শে নভেম্বর হৃদরোগে মারা যান। প্রিন্সিপাল শাহাদত আলম ঝুনু (৫৭) ২৫শে আগস্ট গ্রেপ্তার হয়ে ২৬শে নভেম্বর হার্ট অ্যাটাকে মারা যান; পরিবারের বক্তব্য, তার মৃত্যুর পেছনে নির্যাতন ছিল। আব্দুল মতিন মিঠু (৬৫) ৩রা নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ৯ই ডিসেম্বর মারা যান, তার পরিবারের অভিযোগ অপচিকিৎসা। সিরাজগঞ্জের আতাউর রহমান আঙ্গুর (৫৫) ১লা নভেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১০ই নভেম্বর শ্বাসকষ্টে মৃত্যুবরণ করেছেন, পরিবার অপচিকিৎসার অভিযোগ তুলেছে। মানিকগঞ্জের নিত্য সরকার (৪৪) ৩০শে অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে ২০২৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি অসুস্থতায় মারা যান; পরিবারের মতে, তার মৃত্যু নির্যাতনের কারণে। গাজীপুরের শ্রমিক লীগ নেতা শেখ জহিরুল ইসলাম ৫ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১০ই জানুয়ারি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান; পরিবার নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। নীলফামারীর মোমিনুর ইসলাম (৫০) ১২ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ১৪ই জানুয়ারি অ্যাজমার কারণে মারা যান এবং পরিবারের অভিযোগ অপচিকিৎসা। খুলনার আখতার শিকদার (৪৪) ২৭শে জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ৯ই ফেব্রুয়ারি মারা যান; পরিবার নির্যাতনের কথাই উল্লেখ করেছে। সাভারের আব্দুর রাজ্জাক (৫০) ৬ই অক্টোবর গ্রেপ্তার হয়ে ১৩ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পরিবারের মতে এটি নির্যাতনের সঙ্গে সম্পর্কিত। নওগাঁর সিদ্দিক হোসেন মোল্লা (৪৫) ৪ঠা ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ১৮ই ফেব্রুয়ারি মারা যান। টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম শিপু ২২শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ২৩শে ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেছেন এবং পরিবারের মতে এটি নির্যাতনের ফল। বগুড়ার এমদাদুল হক ভুট্টো (৫১) ২৬শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ১১ই মার্চ মারা যান। কিশোরগঞ্জের সুজিত চন্দ্র দে (৪০) ১৮ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ২রা এপ্রিল মারা যান; পরিবার তার মৃত্যুকে সন্দেহজনক মনে করেছে। সুনামগঞ্জের রিয়াজুল ইসলাম (৭৪) ৩০শে মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে ৯ই এপ্রিল চিকিৎসা অবহেলার কারণে মারা যান। চট্টগ্রামের ফরজাদ হোসেন সজিব ২৭শে মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে ২৫<ে এপ্রিল মারা যান, পরিবারের মতে নির্যাতন। কুমিল্লার ইমাম হোসেন বাচ্চু ৩০শে মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে ৩১শে মে মৃত্যুবরণ করেছেন; পরিবার তার মৃত্যু সন্দেহজনক বলে মনে করছে। ঢাকা দক্ষিণের মো. আজগর আলী ৭ই জুন মৃত্যুবরণ করেছেন, পরিবার নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। সাভারের সৈয়দুর রহমান সুজন (৪৫) ২০শে জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ১৫ই জুন মারা যান এবং পরিবার অপচিকিৎসার অভিযোগ করেছে। মানিকগঞ্জের বাবুল হোসেন (৫৫) ১৭ই এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেছেন; পরিবার তার মৃত্যুকে সন্দেহজনক উল্লেখ করেছে। মুন্সিগঞ্জের সরওয়ার হোসেন নান্নু (৬০) ৫ই মে গ্রেপ্তার হয়ে ২৭শে জুলাই মারা যান; পরিবার সন্দেহজনক মৃত্যুর কথা জানিয়েছে। মাদারীপুরের ইউসুফ আলী মিয়া (৭০) ৯ই ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হয়ে ২৮শে জুলাই মারা যান, পরিবারের মতে অপচিকিৎসার কারণে। কেরানীগঞ্জ/সাভারের শরীফ আহমেদ ১৭ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন; পরিবার নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে। গাইবান্ধার আবু বকর সিদ্দিক মুন্না ২রা সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার হয়ে ২২শে সেপ্টেম্বর মারা যান। নারায়ণগঞ্জের সাবেক মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন (৭৫) ২৫শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে ডিএমসিএইচে মৃত্যুবরণ করেছেন; পরিবারের মতে মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল। খুলনার জয়নাল আবেদীন জনি (৪৫) ৮ই আগস্ট ২০২৫ গ্রেপ্তার হয়ে ১০ই অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেছেন এবং তার পরিবারের অভিযোগ অনুযায়ী এটি পরিকল্পিত হত্যার সম্ভাবনা রয়েছে। সিরাজগঞ্জের আহমদ মোস্তফা খান বাচ্চু ২৮শে অক্টোবর ২০২৫ মৃত্যু বরণ করেছেন; পরিবার চিকিৎসা অবহেলার দায় স্বীকার করেছে। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালের বাইরে কাঁদতে কাঁদতে রুবিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী গত নির্বাচনের সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচারণায় ছিল। এখন মিথ্যা মামলায় কারাগারে। তার হার্টের সমস্যা পুরনো, কিন্তু রিমান্ডে যাওয়ার পর থেকে ওষুধই দেওয়া হয়নি। আমরা ডাক্তার দেখাতে চাইলে পুলিশ বলে—‘ডাক্তার দরকার নেই, ও ভালো আছে।’ এই ভালো থাকার প্রমাণ এখন মৃত্যু সনদে লেখা থাকবে।” রুবিনার অভিযোগের অনুরূপ বক্তব্য মিলেছে অন্তত ১২টি পরিবারের কাছ থেকে, যাদের সবাই সম্প্রতি কোনো না কোনোভাবে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের দাবি—পুলিশ হেফাজতে থাকা ব্যক্তির অসুস্থতা স্বীকার করতে চিকিৎসকদের ওপর “উপরমহলের নির্দেশ” থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক বলেন,রিমান্ডে বা কারাগার থেকে কেউ এলে সবসময় পুলিশের একজন বা দুজন সদস্য উপস্থিত থাকেন। অনেক সময় তারা রিপোর্ট দেখার আগেই বলে দেন—‘স্যার, ঠিক আছে তো? ওরা ভালো আছে লিখে দেন।’ এটা হয়তো কোনো লিখিত নির্দেশ নয়, কিন্তু এমন চাপ তৈরি হয় যে ভিন্ন কিছু লেখার সাহস করা যায় না।” বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) একজন সিনিয়র সদস্য বলেন, এটা কোনো নতুন ঘটনা নয়, তবে এখন ব্যাপক আকারে অভিযোগ আসছে। চিকিৎসকরা নিরপেক্ষভাবে সার্টিফিকেট দিতে পারলে অনেক মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।” মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ ও ‘মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন’ জানিয়েছে, গত ছয় মাসে পুলিশি হেফাজত বা কারাবন্দী অবস্থায় ৪৩ জনের মৃত্যুর খবর নথিভুক্ত হয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত ১৭ জন রাজনৈতিক কর্মী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর আগে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়নি বলে পরিবার দাবি করেছে। বিডিডাইজেস্ট একাধিক জেলা কারা কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। অধিকাংশই আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ঢাকা মহানগর পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কেবল বলেন,চিকিৎসা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত হাসপাতালের, পুলিশ কেবল নিরাপত্তা দেয়। কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন—এই ‘নিরাপত্তা’ই প্রায়শই অনুচ্চারিত হুমকিতে রূপ নেয়। এক চিকিৎসক বলেন, রিপোর্ট লিখে পুলিশের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বোঝা যায় কী লেখা তারা চায়। অন্যদিকে, কারা অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা স্বীকার করেন, চিকিৎসা ব্যবস্থায় ঘাটতি আছে, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দেওয়ার বিষয় আমরা জানি না। কেউ প্রমাণসহ অভিযোগ করলে তদন্ত হবে। বাংলাদেশের কারা আইন (কারাগার বিধি ২০০৬) অনুযায়ী, কোনো বন্দী অসুস্থ হলে অবিলম্বে সরকারি চিকিৎসক দ্বারা পরীক্ষা করানো এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে পাঠানো বাধ্যতামূলক। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল কাউন্সিলের নীতিমালায় বলা আছে—চিকিৎসকের পেশাগত মতামতে কোনো রকম বাহ্যিক প্রভাব থাকলে তা পেশাগত অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে বাস্তবে এসব নীতিমালা কার্যকর হচ্ছে না বলেই মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবীরা। কারা হেফাজতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিভিন্ন তথ্য এখানে