বাংলাদেশে হিন্দু-সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত উস্কানি: টিএমডি হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গণহত্যার প্রচারণা

২৯ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:২২ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তুষের আগুনের মতো ধিকিধিকি জ্বলছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় টিএমডি (TMD) হ্যাশট্যাগে চলমান ক্যাম্পেইনে হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, এবং ইসকনের নামে হিন্দুদের হত্যার জন্য সমর্থন সৃষ্টি করা হচ্ছে। এই হ্যাশট্যাগটি আসলে “Total Malaun Death“-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, যা হিন্দুদের অপমানজনকভাবে “মালাউন” বলে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার ইঙ্গিত করা হচ্ছে। যদিও কিছু প্ল্যাটফর্মে এটিকে “Total Misti Distribution” বা “Total Meat Distribution” নিরীহ নামে উপস্থাপন করা হচ্ছে, তবু এর মূলে রয়েছে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রচারণা। বিডিডাইজেস্ট এই অনুসন্ধানে ফেসবুকে “Total Mishti Distribution TMD” নামে একটি সক্রিয় পাবলিক গ্রুপ এর সন্ধান পাওয়া যায় , যার প্রায় ২,৫০০ সদস্য রয়েছে। এই গ্রুপে প্রতিদিন একাধিক পোস্ট শেয়ার হয়, যা প্রায়শই ইসকন (ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণা কনশাসনেস) এবং অন্যান্য হিন্দু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক। পোস্টগুলোতে পাবলিক রিয়াকশন অনেক বড় পেইজ থেকেও বেশী। ২০২৪ এর ডিসেম্বর থেকে নতুন রুপে শুরু হওয়া #TMD হ্যাশটাগের পোস্টের সংখ্যা এখন প্রায় আড়াইলাখ। এই পাবলিক গ্রুপ ছাড়া, আরো অনেক প্রাইভেট গ্রুপের কথা জানা যায় বিভিন্ন পোস্টের কমেন্টে। ঐ সকল প্রাইভেটগ্রুপে ঢুকতে হলে, নির্দিষ্ট ইসলামিস্ট গ্রুপের সাথে কোন না কোনভাবে পরিচিত থাকতে হবে, খুবই গোপনীয়তার সাথে ঐ সকল গ্রুপগুলো পরিচালনা করা হয়। প্রাইভেট গ্রুপ থেকে মেম্বারদের বিভিন্ন সনাতানী ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য দেয়া হয় এবং একইসাথে এই ক্যাম্পেইনের দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়। বিশ্বস্থ সদস্য ছাড়া বা নির্দিষ্ট মাদ্রাসাভিত্তিক কোরাম ছাড়া ঐ সকল গ্রুপে ঢোকার অনুমতি নাই কারোই। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে মাদ্রাসা-সংশ্লিষ্ট যুবকদের বেশী প্রাধান্য দেখা যায়, এবং তারা হিন্দু-বিরোধী কনটেন্ট শেয়ার করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘৃনা ছড়িয়ে জনমত গঠন করছে।চট্টগ্রামের আইনজীবী আলিফের হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক মাউলানা মুহিবুল্লাহর অন্তর্ধানের ঘটনা—বুয়েটের সনাতানী ছাত্রের নারী অবমাননা থেকে শুরু করে প্রতিটি ধর্ম অবামাননার অভিযোগে অভিযুক্ত ঘটনাগুলো এই গ্রুপগুলোতে ব্যবহার করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে “জিহাদ”-এর প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছে।এছাড়াও, বিগত সময়ে বিভিন্ন স্থানে মন্দির হামলা, হিন্দুদের উপর আক্রমণ বা কোন হিন্দুকে ফাসাতে ভুয়া স্ক্রিনশট বানিয়ে ধর্ম অবমানার অভিযোগ আনা সম্পর্কিত সকল পরিকল্পনা এই সকল গ্রুপের মাধ্যমেই হয়। সদস্যরা সোশাল মিডিয়া থেকে টার্গেট ঠিক করে, তথ্য দেয়, আর বিভিন্ন প্রাইভেট গ্রুপের থিংক ট্যাংকরা সেই অনুযায়ি পরিকল্পনা সাজায়। বিডিডাইজেস্টের সারাদিনের অনুসন্ধানে, এটা নিশ্চিত হওইয়া গেছে যে, বিগত সময়ে যতো হিন্দুদের উপর বা মন্দিরে আক্রমণ হয়েছে, এগুলো কোনটাই আকস্মাত ঘটনা ছিল না। এগুলো সবই হয়েছে TMD ক্যাম্পেইন এর লক্ষ্য কে উদ্দেশ্য করে। ব্লগার ও অনলাইন একটিভিস্ট আরিফ জেবতিক ইউটিউবে এক ভিডিওতে বলেন, “এই সকল ক্যাম্পেইনগুলোর লক্ষ্য বাংলাদেশে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরি করে, এবং এর উপর ভর করে ইসলামই খেলাফত প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘ সময় কোন নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতা দখল করা”। এই ক্যাম্পেইনের পটভূমিতে “গাজওয়াতুল হিন্দ”-এর ধারণা প্রচারিত হচ্ছে, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামী বিজয়ের একটি ধর্মীয় কনসেপ্ট। ইসলামী শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী’র কে আইডল মেনে তার অনুকারনে হিন্দু নিধনে উদবুদ্ধ করে হচ্ছে এইসকল প্রাইভেট অ পাবলিক গ্রুপগুলোতে। বাংলাদেশের মুসলিম যুবকদের মধ্যে অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং হিন্দু-বিরোধী প্রচারণা এই লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এসব কার্যকলাপ গোপনে চললেও, ৫ আগস্টের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন শাসনামলে এরা আরও সাহসী হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকারের পতন এবং নতুন সরকারের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতায়িত মনে করে, এরা সকল বিধি-বিধান উর্ধে মনে করছে নিজেদের। মীম, ফটোকার্ড এবং হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে হিন্দু-হত্যার প্রত্যক্ষ ইচ্ছা প্রকাশ করা হচ্ছে এই সকল পাবলিক ও প্রাইভেট গ্রুপগুলোতে, যা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সনাতন ধর্মাবলম্বী-দের খুব সতর্কতার সাথে পোস্ট বা কমেন্ট করতে হচ্ছে। কোন মুসলমান একটিভিস্ট এর মন্তব্য TMD গ্রুপ অগ্রাহ্য করলেও, সনাতনীদের সকল বক্তব্যকে এরা উপলক্ষ্য হিসাবে গ্রহন করছে। সাথে যুক্ত হচ্ছে ভারত বা, কোলকাতার হিন্দুত্ববাদী একটিভিস্ট দের আক্রমণাত্মক কমেন্ট।হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এই উস্কানির বিরুদ্ধে সতর্কতা জারি করেছেন, তবে সরকারি পর্যায়ে এখনও কোনো কঠোর ব্যবস্থার খবর পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ধরনের অনলাইন বিদ্বেষকে নজরে রাখছে, কারণ এটি বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে হয়েছে বিভিন্ন কোণ থেকে, এবং সরকারকে দ্রুত হস্তক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়েছে।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমনিতেই দেশে আইন বিচার ব্যবস্থা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব নেই গত ১৪ মাস ধরে। যে যেভাবে খুশি প্রতিপক্ষকে দমন করছে এই সুযোগে। প্রতিমাসেই নদীতে লাশের সংখ্যা বাড়ছে। এই আইনহীনতা আর বিচারহীনতা উগ্র মৌলবাদী আর সাম্প্রদায়িক ব্যাক্তিদের সাহসী করে তুলছে। তারা এটাকে যে কোন মুহুর্তে সুযোগ হিসাবে গ্রহন করে ইসকন নিধন শুরু করে দিতে পারে। তারা আরো মনে করেন, যে কোন সংস্কারের থেকে সরকারের এখন সবচেয়ে বেশী প্রাধান্য দেয়া উচিত আইন শৃঙ্খলা উন্নয়নে। সুযোগসন্ধানী জঙ্গি আর উগ্রবাদীদের মনে এতোগুলো বছর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি যেই ভয় ছিল, সেই ভয় ফিরিয়ে আনাটা এখন সবচেয়ে জরুরী।