সাংবাদিক ইলিয়াসের পরামর্শে ‘অপহরণ’ নাটক সাজান মুফতি মুহিব্বুল্লাহ!

সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল ট্র্যাকিং ও চিকিৎসকের রিপোর্টে চরম অসঙ্গতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ কর্মকর্তার দাবি: মুফতি মুহিব্বুল্লাহ সাংবাদিক ইলিয়াসের পরামর্শে নিজেই নিজের ‘অপহরণ’ সাজিয়েছেন।

২৮ অক্টোবর, ২০২৫ | ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

গাজীপুরের টঙ্গীর টিঅ্যান্ডটি কলোনি জামে মসজিদের খতিব মুফতি মোহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজীর দাবি করা ‘অপহরণের’ ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত সাজানো নাটক হিসেবেই প্রমাণিত হতে চলেছে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনাটির নেপথ্যে খোদ একজন সাংবাদিকের (ইলিয়াস) পরামর্শ রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা। গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টায় টঙ্গী থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরদিন পঞ্চগড়ে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধারের দাবি করেছিলেন ৬০ বছর বয়সী এই খতিব। তবে দেশকাল নিউজ ডটকমের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল ট্র্যাকিং এবং পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জনের বক্তব্য অনুযায়ী—মুহিব্বুল্লাহর অপহরণের দাবি পুরোপুরি মিথ্যা এবং এর পরিকল্পনায় সাংবাদিক ইলিয়াসের ভূমিকা ছিল। তদন্ত শেষে এই খতিবের বিরুদ্ধেই অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিতে চলেছে পুলিশ। অপহরণের ঘটনা সাজানোর জন্য যে ধারায় তিনি মামলা করেছেন, সেই ধারায়ই তিনি এখন আসামি হতে চলেছেন। মুফতি নিজেই ‘শিকল’ পরিয়েছিলেন, নেপথ্যে ইলিয়াসের পরামর্শ ঘটনাটির তদন্তের সঙ্গে সম্পৃক্ত গাজীপুর পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, মুফতি মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী নিজেকে অপহরণের এই নাটক সাজিয়েছেন সাংবাদিক ইলিয়াসের পরামর্শে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মুফতি মুহিব্বুল্লাহ সাংবাদিক ইলিয়াসের পরামর্শে এই ঘটনা সাজিয়েছেন। মুহিব্বুল্লাহ নিজেই নিজের পায়ের সঙ্গে শিকল লাগিয়ে শুয়ে ছিলেন। তাকে পঞ্চগড় কেউ নেয় নাই। সে নিজের মামলায় নিজেই আসামি হবে।” তিনি আরও যোগ করেন, খতিব যে টানা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন, সেই অনুযায়ী তার শরীরে আঘাতের কোনো দাগ নেই। পুলিশের দাবি, এই ঘটনা সাজানোর সব ভিডিও প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজই প্রধান প্রমাণ: দ্রুত হেঁটে গেলেন দুই কিমি মুহিব্বুল্লাহ মিয়াজী গত ২২ অক্টোবর সকাল ৭টায় টঙ্গীর শিলমুন এক্সিস লিংক সিএনজি ফিলিং অ্যান্ড কনভার্সন সেন্টারের সামনে থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নেওয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু আমাদের হাতে আসা একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ তার সেই দাবিকে সরাসরি মিথ্যা প্রমাণ করেছে। ফুটেজে যা দেখা যায়: দ্রুত হেঁটে যাওয়া: সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে মুহিব্বুল্লাহকে কথিত অপহরণের স্থান—শিলমুন সিএনজি ফিলিং স্টেশনের সামনে দিয়ে দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে দেখা যায়। তার সঙ্গে কেউ ছিল না। অ্যাম্বুলেন্স অনুপস্থিতি: তিনি যে সময়ের কথা বলেছেন, তার ১০ মিনিট পরেও ঘটনাস্থলে কোনো অ্যাম্বুলেন্সের দেখা মেলেনি। দীর্ঘ পথ অতিক্রম: ফুটেজে দেখা যায়, ৬টা ৫৪ মিনিটে মসজিদ থেকে রওনা হওয়ার পর তিনি হেঁটে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফিলিং স্টেশনে পৌঁছান। এরপরও তিনি আরও প্রায় এক কিলোমিটার দ্রুত হেঁটে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতা পার হয়ে যান। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘ পথ হেঁটে সিসিটিভি ক্যামেরার আড়াল হয়ে মুহিব্বুল্লাহ নিজেই যানবাহনে উঠে চলে গেছেন। মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানতে পেরেছে, তিনি প্রথমে সিরাজগঞ্জ এবং পরে সেখান থেকে পঞ্চগড় যান। ফিলিং স্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. সোলেইমানও নিশ্চিত করেছেন, পুলিশকে তারা ফুটেজ দিয়েছেন এবং ফুটেজে হুজুরকে একাই হেঁটে যেতে দেখা গেছে, অপহরণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। মারধরের চিহ্নও মিথ্যা: চিকিৎসকের রিপোর্ট মুহিব্বুল্লাহ দাবি করেছিলেন, তাকে টানা নির্যাতন করা হয়েছে এবং কাচের বোতলে পানি ভরে আঘাত করা হয়েছে। এই বিষয়েও চরম অসঙ্গতি পাওয়া গেছে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের চিকিৎসকের বক্তব্যে। জেলার সিভিল সার্জন মো. মিজানুর রহমান বলেন, “আপনি যদি জানতে চান, শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল কি না, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে উনাকে মারধর করা হয়েছে? না, তেমন কিছু আমরা পাইনি।” সিভিল সার্জন আরও জানান, ব্যথা অনুভব করার কথা বলায় তাকে ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু দৃশ্যমান কোনো জখম বা আঘাতের চিহ্ন ছিল না। নাটকের নেপথ্যে কী? মুহিব্বুল্লাহ অপহরণের কারণ হিসেবে ১১ মাস ধরে আসা বেনামি চিঠির হুমকিকে দায়ী করেন। চিঠিতে তাকে ‘অখণ্ড ভারত মাতা’র পক্ষে কথা বলতে, ইসকনের পক্ষে জনমত গঠন করতে এবং ইসলামভিত্তিক দলগুলোর বিরুদ্ধে খুতবা দিতে বলা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন, এসব চিঠি আসার ঘটনাকে কেন্দ্র করে খতিব মূলত প্রচার পেতে, অথবা সাংবাদিক ইলিয়াসের পরামর্শে অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই নাটক সাজিয়ে থাকতে পারেন। বর্তমানে মুহিব্বুল্লাহ অসুস্থতার কথা বলে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি আছেন এবং পুলিশের কড়া নজরদারিতে রয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছে, নাটক প্রমাণিত হওয়ায় তিনি যেকোনো সময় গ্রেপ্তার হতে পারেন এবং তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে।