প্রটোকল-শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে ড. ইউনূসের সামনে ব্যাটন বগলে পাকি জেনারেল, কী ইঙ্গিত দিলেন?

২৭ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:২০ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় শনিবার রাতে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে প্রকাশিত সাক্ষাতের ছবিতে দেখা যায়, জেনারেল মির্জার বগলে একটি ব্যাটন, যা সাধারণত সেনাবাহিনীর আনুষ্ঠানিক প্রথা অনুযায়ী বহন করা হয়। এই লাঠি সামরিক পরিভাষায় “সোয়াগার স্টিক” নামে পরিচিত। তবে, অন্য কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময় এই স্টিক বহন করা সম্পূর্ণ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বিষয়। তাই এ নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। দীর্ঘ ২৩ বছর বাংলাদেশের ওপর নির্যাতন-নিষ্পেষণ চালানো পাকিস্তানকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করে অর্জিত বাংলাদেশকে কি পাকি জেনারেল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, বর্তমান বাংলাদেশকে দরিদ্র পাকিস্তানের আজ্ঞাবহ বলে শারীরিক অভিব্যক্তিতে বোঝানোর চেষ্টা করলেন? এমন প্রশ্ন উঠেছে ইতিমধ্যে। সোয়াগার স্টিক কী এবং কেন? ঐতিহাসিকভাবে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ড্রিল, প্রশিক্ষণ, পরিদর্শন ও আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমে এই স্টিক ব্যবহার শুরু করেন। মূলত এটি দূরত্ব নির্ধারণ, নির্দেশ প্রদান ও সৈন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ করার উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সময়ের সাথে সাথে সোয়াগার স্টিক হয়ে ওঠে সামরিক ঐতিহ্য ও প্রতীকী আনুষঙ্গিক বস্তু। বর্তমানে এটি কর্তৃত্ব, নেতৃত্ব ও কমান্ডের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। একজন কর্মকর্তার পদমর্যাদা, দায়িত্ববোধ এবং আত্মবিশ্বাসের প্রকাশ হিসেবেও এর ব্যবহার দেখা যায়। কুচকাওয়াজ, পরিদর্শন, দায়িত্ব হস্তান্তর অনুষ্ঠান বা অন্যান্য সামরিক আনুষ্ঠানিকতায় সোয়াগার স্টিক এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ড্রিল বা ব্রিফিংয়ের সময় কর্মকর্তারা এটি ব্যবহার করেন নির্দেশনা দেওয়া, ভুল সংশোধন বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জোর দেওয়ার জন্য। অতএব, সোয়াগার স্টিকের ব্যবহার মূলত সামরিক পরিবেশ ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু কোনো কূটনৈতিক সাক্ষাতে এটি হাতে বহন করা আন্তর্জাতিক প্রটোকল অনুযায়ী কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে এখন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের আইন কী বলছে? বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার ক্ষেত্রে কঠোর নিরাপত্তা বিধান কার্যকর থাকে। দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ব্যাটন, লাঠি বা অনুরূপ কোনো বস্তু সঙ্গে নিয়ে সরকারপ্রধানের উপস্থিত স্থানে প্রবেশ করতে পারেন না। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (এসএসএফ) এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রাখে। প্রবেশের আগে প্রত্যেককে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে তল্লাশি করা হয় এবং অস্ত্রসদৃশ যেকোনো বস্তু—যেমন ব্যাটন, লাঠি, ধাতব প্রান্তযুক্ত ছাতা, ধারালো কলম বা অন্যান্য সরঞ্জাম—সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের অস্ত্র আইন ও জননিরাপত্তা নীতিমালা অনুসারে ব্যাটনকে প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক সরঞ্জাম হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। যদিও কেউ ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অংশ হিসেবে এটি বহন করতে পারেন, তবু উচ্চ নিরাপত্তা অঞ্চল বা সরকারপ্রধানের উপস্থিত স্থানে এর বহন অনুমোদিত নয়। শুধুমাত্র অনুমোদিত নিরাপত্তা সংস্থা—যেমন এসএসএফ, পুলিশ বা প্রটোকল কর্মকর্তারা—সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় এমন সরঞ্জাম বহন করতে পারেন। বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রেও এই বিধি প্রযোজ্য, যদি না বিশেষ কূটনৈতিক অনুমতি নেওয়া থাকে। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জনসমাগম বা সংবেদনশীল এলাকায় অস্ত্র, লাঠি বা লাঠিসদৃশ কোনো বস্তু বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই বিধান থেকেই স্পষ্ট, ব্যাটন বা সোয়াগার স্টিকের মতো বস্তু সরকারপ্রধানের উপস্থিত স্থানে বহন আইনত নিষিদ্ধ। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রটোকল ইস্যু প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস এবং পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা-এর এই সাক্ষাতের ছবি দুই দেশের দুটি ভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রতিফলিত করে—একজন বেসামরিক সরকারপ্রধান, অন্যজন সামরিক কর্মকর্তা। তবে ছবিতে জেনারেল মির্জার হাতে সোয়াগার স্টিক থাকায় এটি একটি সামরিক ভঙ্গিমা ও ক্ষমতার প্রতীকী চিত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে, যা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের প্রশ্ন তুলেছে। সাধারণত এমন আনুষ্ঠানিক বৈঠক জনমনে সমন্বয়, আস্থা ও সহযোগিতার বার্তা দেয়। কিন্তু এখানে সামরিক আনুষঙ্গিকতা এবং প্রটোকল লঙ্ঘনের ফলে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। প্রটোকল ভঙ্গের দিক গ্রুপ ছবিতেও দেখা গেছে, আনুষ্ঠানিক প্রটোকল অনুসরণ করা হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান নিজে মাঝখানে দাঁড়ান, এবং দুই পাশে সমসংখ্যক প্রতিনিধি অবস্থান করেন। কিন্তু প্রকাশিত ছবিতে প্রধান উপদেষ্টার ডান পাশে চারজন, বাম পাশে ছয়জন দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেছে। ইউনূসের বাম পাশে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব খলিলুর রহমান, সেনাসদর দপ্তরের দুই মেজর জেনারেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা এবং একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। অন্যদিকে, ডান পাশে ছিলেন জেনারেল মির্জা, ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার, পাকিস্তান নৌবাহিনীর এক কমোডর, সেনাবাহিনীর দুই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এবং একজন দূতাবাস কর্মকর্তা। ছবিতে লক্ষ্যণীয় যে, বাংলাদেশের কোনো সেনা কর্মকর্তার হাতে ব্যাটন বা সোয়াগার স্টিক ছিল না, কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলের হাতে তা দৃশ্যমান। ফলে দৃশ্যত এমন একটি বার্তা তৈরি হয় যে, সামরিক উপস্থিতির ক্ষেত্রে শামশাদ মির্জাই সর্বোচ্চ পদমর্যাদার ব্যক্তি, আর বাকিরা তাঁর অধীনস্থ কর্মকর্তার মতো অবস্থানে রয়েছেন। এই ভিজ্যুয়াল প্রতীকি বার্তাই এখন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। চলছে তীব্র সমালোচনা এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও লেখক হাসান মোর্শেদ লিখেছেন: পাকিস্তানের জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জা যে লাঠিখানি বগলদাবা করে রেখেছেন সেটি স্ট্যাগার স্টিক (Swagger Stick)। সামরিক কর্মকর্তারা নিজেদের অথরিটি/ কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে এটি বহন করেন। কোন সামরিক কর্মকর্তা যখন নিজ রাষ্ট্রের অথবা অন্য রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সাথে সাক্ষাৎ করবেন তখন এই স্টিক বহন না করা হচ্ছে কুটনৈতিক শিষ্টাচার। কারণ তিনি যতোবড় জেনারেলই হন, একজন সরকার প্রধানের সমকক্ষ নন। সরকার প্রধানের সামনে তিনি অথরিটি সিম্বল বহন করবেন না। তিনি কিছু ঘটনার তুলনা দিয়ে বলেন: বৃটিশ চিফ অফ জেনারেল স্টাফ জেনারেল স্যান্ডার্স যখন নেপালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচন্ডের সাথে দেখা করেন, তখন এই স্টিক বহন করেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে মিত্র বাহিনীর প্রধান পাঁচ তারকা জেনারেল আইসেন হাওয়ার যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সাথে দেখা করেন তখনো স্টিকবিহীন। দোর্দন্ড সোভিয়েত জেনারেলগণ কোন দুর্বল রাষ্ট্রের সরকার প্রধানের সাথে দেখা করলেও এই কুটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলতেন। ভারতীয় জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার, বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎ করার ঐতিহাসিক ছবিও মনে করা যেতে পারে। শব্দ, প্রতীক, উপমা, শারীরিক ভাষা- অনেক সময় অনেক কিছুর ইংগিত দেয়। অস্বীকার করলেই মিথ্যা হয়ে যায় না।