বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক: ইউনূসের ইসলামাবাদপন্থী নীতিতে উদ্বেগ

২৬ অক্টোবর, ২০২৫ | ৭:২৬ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

ইউনূস সরকারের নেতৃত্বে দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক জোরদারের পথে এগোচ্ছে। এই নীতি জনমানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে, বিশেষ করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায়। গত ২৪ ঘণ্টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি বিজ্ঞপ্তি এই সম্পর্কের গভীরতা নির্দেশ করে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানি সামরিক প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরপ্রথম বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ প্রধান কর্মকর্তা কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার নেতৃত্বে একটি ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। এই সফরের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা। তবে, একজন নির্বাসিত বাংলাদেশী সেনা জেনারেল নাম প্রকাশ না করে বলেন, “এই সফর থেকে আমাদের কী লাভ হবে তা বোধগম্য নয়। পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী চীনের প্রভাবে পরিচালিত এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় তারা আমাদের বিনামূল্যে কিছু দিতে পারবে না। এটি আমাদের বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।” তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, পাকিস্তানি প্রশিক্ষকদের হাতে বাংলাদেশী সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে তা অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ‘বিপর্যয়’ হতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি বাংলাদেশের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তাই তাদের প্রশিক্ষণ আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য তেমন কার্যকর হবে না। দ্বিতীয় বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ইমরান হায়দার এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এমডি তৌহিদ হোসেনের বৈঠকের পর দুই দশক ধরে নিষ্ক্রিয় জয়েন্ট ইকোনমিক কমিশন আগামী ২৭শে অক্টোবর ঢাকায় পুনরায় চালু হবে। এই উদ্যোগ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গৃহীত। এর আগে গত আগস্টে পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের ঢাকা সফরে দুই দেশ সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। এছাড়া, পাকিস্তান বাংলাদেশী ছাত্রদের জন্য ৫০০টি বৃত্তি এবং সিভিল সার্ভেন্টদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার ২৫ শতাংশ চিকিৎসা শিক্ষার জন্য বরাদ্দ। এই সম্পর্কের অগ্রগতি সাধারণ বাংলাদেশীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের স্মৃতি এখনও জনমানসে তাজা। বিএনপি থেকে বরখাস্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান বলেন, “বাঙালি হিসেবে আমরা পাকিস্তানের অত্যাচার ভুলতে পারি না। তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক পুনরায় খোলা যাবে না।” তবে, জামায়াতে ইসলামী এবং বিএনপির একাংশের মতো কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই সম্পর্কের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে, যা ভারত-বিরোধী মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের জন্য তেমন লাভজনক নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে পাকিস্তানের রপ্তানি প্রায় ৭৭৮ মিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি নগণ্য। বাণিজ্যের পরিধি সীমিত, এবং করাচি-চট্টগ্রাম সমুদ্রপথ অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর নয়।” তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানি বৃত্তি প্রোগ্রাম বাংলাদেশী ছাত্রদের কাছে আকর্ষণীয় নয়, কারণ তাদের পাসপোর্টে পাকিস্তানি সীল পশ্চিমা দেশগুলোতে ভিসা পাওয়া কঠিন করে দিতে পারে। এদিকে, পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত পণ্যের কায়িক পরীক্ষণ বাতিলের সিদ্ধান্ত ভারতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থার মাঝে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে নেওয়া বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি পাকিস্তানের তুলনায় ভিন্ন এবং এই সম্পর্ক ভারত-বিরোধী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। দেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী বলেন, “পাকিস্তান নিজেই অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। তারা আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে?” বাংলাদেশের অর্থনীতি একসময় দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি ছিল, বর্তমানে শিল্প বন্ধ, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাসের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইন্ডো-প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের নির্বাহী পরিচালক শাহাব এনাম খান বলেন, “বাণিজ্য বৈচিত্র্যের জন্য পাকিস্তান একটি বিকল্প হতে পারে, তবে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। পাকিস্তান সম্ভবত একটি স্থিতিশীল সরকারের জন্য অপেক্ষা করবে।” ড. ইউনূসের পাকিস্তানপন্থী নীতি তার খরচ-লাভ বিশ্লেষণের প্রতিফলন হলেও, এটি সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং জনমানুষের সংবেদনশীলতা বিবেচনায় এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সাধারণ বাংলাদেশীদের প্রত্যাশা শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, যা এই নতুন কূটনৈতিক দিকপরিবর্তনের মাধ্যমে অর্জিত হবে কিনা, তা এখনও অনিশ্চিত।