বিপর্যয়ের পথে অর্থনীতি: মূল্যস্ফীতির আগুনে পুড়ছে জনজীবন, নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতা চরমে

২৬ অক্টোবর, ২০২৫ | ৭:২৪ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

দেশের অর্থনীতি এখন এক ভয়াবহ ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে— একদিকে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে স্থবির মজুরি ও বিনিয়োগ। টানা প্রায় চার বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষের আয় দামবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোটি মানুষের জীবনযাত্রা আজ ভয়ানক চাপে। কেউ সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন, কেউ ধার করছেন, কেউ মৌলিক খরচ কমিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। অথচ নীতিনির্ধারক মহলে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ বা দায়বোধের ছাপ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর মাসে গড় মজুরি বেড়েছে ৮.০২ শতাংশ, কিন্তু একই সময় মূল্যস্ফীতি ৮.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ প্রকৃত আয় নেতিবাচক। টানা তিন মাস ধরে এই ব্যবধান বাড়ছে— যা শ্রমবাজারে এক নীরব সংকট তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “শ্রমিকরা এখন দুই দিক থেকে আঘাত পাচ্ছেন— মজুরি বাড়ছে না, কিন্তু জীবনযাত্রার খরচ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটা যেন মাথা ও পায়ে একসঙ্গে আঘাত।” অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাস্তব আয়ের সংকট আরও গভীর হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও নীতিনির্ধারণে দ্বিধা—সব মিলিয়ে অর্থনীতির মেরুদণ্ড ক্রমেই নরম হয়ে পড়ছে। চাল, ডাল, তেল, ওষুধ, বাসাভাড়া—সব ক্ষেত্রেই দাম বাড়ছে লাগাতার। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮.৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আগের মাসের তুলনায়ও বেশি। আয় না বাড়ায় মানুষ কম খাচ্ছে, কম চিকিৎসা নিচ্ছে, সন্তানদের পড়াশোনায় খরচ কমাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা এখন ২ কোটি ৩৬ লাখ— এক বছরে বেড়েছে ৭০ লাখ। এটি শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং সরকারের অর্থনৈতিক ব্যর্থতার নির্মম প্রতিচ্ছবি। দেশের প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে— মাত্র ৩.৬৯ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ৬.৩৫ শতাংশে নেমেছে, যা দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। উচ্চ সুদ, ডলার সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দুর্বল ব্যাংকিং খাত উদ্যোক্তাদের আস্থা গিলে ফেলেছে। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ স্বীকার করেছেন, “উচ্চ সুদ ও অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। স্থিতিশীলতা ছাড়া কোনো গতি ফেরানো সম্ভব নয়।” বিদেশি বিনিয়োগেও ভয়াবহ ধস— এক বছরে নতুন বিনিয়োগ কমেছে ৬২ শতাংশ। বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন কেবল টিকে থাকার চেষ্টা করছে, নতুন কোনো প্রকল্পে আগ্রহ নেই। বেকার মানুষের সংখ্যা এখন প্রায় ২৭ লাখ। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার সর্বোচ্চ। বিনিয়োগ স্থবিরতায় নতুন কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সমাজে এক নতুন ধরনের হতাশা ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ৮৮ শতাংশ। মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খরচ করছেন, কারণ হাতে নগদ টাকা নেই। সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাপনাও এতে চাপে পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, “সঞ্চয় ভাঙা মানে ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নষ্ট করা— সরকারও যেন সেই পথে হাঁটছে।” তৈরি পোশাক, পাটজাত ও কৃষিপণ্যের রপ্তানি টানা দুই মাস ধরে কমেছে— সেপ্টেম্বরে হ্রাস ৪.৬১ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে চাহিদা কমা, শুল্ক জটিলতা ও উৎপাদন ব্যয়ের বৃদ্ধি এ পতনের মূল কারণ। অর্থনীতিবিদদের মতে, “রপ্তানির এই ধারা ভাঙতে না পারলে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরও প্রকট হবে।” বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, অতিদারিদ্র্যের কাতারে নতুন করে যোগ হয়েছে আরও ৩০ লাখ মানুষ। দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১.২ শতাংশে। সিপিডির অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, “চার বছর ধরে চলমান মূল্যস্ফীতি, মজুরি স্থবিরতা ও বিনিয়োগ হ্রাস—সব মিলিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ভেঙে পড়েছে। এখন সুশাসন ছাড়া কোনো পথ নেই।” অর্থনীতিবিদরা একবাক্যে বলছেন— এটি আর কেবল অর্থনৈতিক সংকট নয়, বরং নীতিনির্ধারক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে— আয় কমছে, দাম বাড়ছে, বিনিয়োগ স্থবির, রপ্তানি কমছে, দারিদ্র্য বাড়ছে। অথচ নীতিনির্ধারকদের মুখে এখনো আত্মতুষ্টির বুলি। জনজীবনের বাস্তব চিত্র বলছে— অর্থনৈতিক চাপ এখন কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি এক সামাজিক বিপর্যয়। সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ, এবং বাজার ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরাতেও অক্ষম। অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, “এখন দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ— খাদ্য সহায়তা বাড়ানো, ওএমএস কার্যক্রম জোরদার করা, এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। তা না হলে অর্থনীতি ‘লো-গ্রোথ ট্র্যাপ’-এ আটকে যাবে।”