অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক চাপ: ভেঙে পড়ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, চোখে অন্ধকার সাধারণ মানুষের
দেশের অর্থনীতি এখন গভীর চাপের মুখে। টানা ৪৪ মাস ধরে শ্রমিকদের মজুরি মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না, ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমেই কমছে। খাদ্য, ভাড়া ও পরিবহন খরচের লাগামহীন বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা। অনেক পরিবার এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছে, এমনকি খাদ্য ও শিক্ষা খরচও কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় ভেঙে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিক শৃঙ্খলা। তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীন লোকদের সংখ্যা বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গড় মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ৮.০২ শতাংশ, কিন্তু একই সময়ে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৩৬ শতাংশ। অর্থাৎ, বাস্তব আয়ে ঘাটতি আরও বেড়েছে। গত তিন মাস ধরে মজুরি বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমছে। জুলাইয়ে ছিল ৮.১৯ শতাংশ, আগস্টে ৮.১৫ শতাংশ, আর সেপ্টেম্বরে নেমে এসেছে ৮.০২ শতাংশে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘শ্রমিকরা এখন দুই দিক থেকে চাপে একদিকে দাম বাড়ছে, অন্যদিকে মজুরি বাড়ছে কম। এটি যেন মাথা ও পায়ে একসঙ্গে আঘাত পাওয়ার মতো পরিস্থিতি।’ তিনি জানান, সেপ্টেম্বর মাসে দেশের সব বিভাগেই মজুরি বৃদ্ধির হার কমেছে, যার মধ্যে খুলনা বিভাগে পতন সবচেয়ে বেশি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ লুৎফর রহমান বলেন, ‘মজুরি বৃদ্ধির এই ধীরগতি অর্থনীতির গভীরতর দুর্বলতা নির্দেশ করছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমেছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।’ বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৩৬ শতাংশে, যা আগের মাসের তুলনায়ও বেশি। চাল, ডাল, তেল, সবজি, ওষুধ ও বাসাভাড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। আয় না বাড়ায় মানুষের বাস্তব ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অনেকেই এখন ধার-ঋণ বা সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালাচ্ছেন। মজুরি না বাড়ায় ও নিত্যপণ্যের মূল্য বেশি থাকায় হিমশিম খাচ্ছেন তারা। অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোক্তা ব্যয় কমিয়ে দিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে চাহিদা সংকোচন তৈরি করতে পারে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শেষে দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ কোটি ৩৬ লাখ। এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ। খাদ্য, বাসাভাড়া, ওষুধ ও পরিবহন খরচ গত তিন বছর ধরে অব্যাহতভাবে বাড়ছে। একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আগে মাসে ৩০ হাজার টাকায় সংসার চলত, এখন একই জিনিস কিনতে লাগে ৪৫ হাজার।” বিবিএসের হিসেবে, গত অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৬৯ শতাংশে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫.৪ থেকে কমিয়ে ৪.৯ শতাংশে এনেছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ, যা গত ২২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘উচ্চ সুদ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। স্থিতিশীলতা ফিরলে বিনিয়োগে গতি আসবে।’ বিবিএসের শ্রমবাজার জরিপ অনুযায়ী, দেশে বেকারত্বের হার ৪.৬৩ শতাংশ। অর্থাৎ বেকার মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। তরুণদের মধ্যে প্রতি ছয় জনের একজন বেকার। আইএলও জানিয়েছে, বিনিয়োগ স্থবিরতা ও রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়ায় শ্রমবাজারে নতুন চাকরির সুযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আয়ের সংকোচনের কারণে মানুষ সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ২০২৫ সালের আগস্টে সঞ্চয়পত্র বিক্রি নেমে এসেছে ২৮৯ কোটি টাকায়, যা এক বছরে প্রায় ৮৮ শতাংশ কম। অর্থনীতিবিদদের মতে, ‘মানুষ এখন হাতে থাকা টাকাই টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থাও চাপে পড়ছে।’ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর দুই মাসেই দেশের রপ্তানি আয় কমেছে। আগস্টে পতন ৩ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে আরও ৪.৬১ শতাংশ। তৈরি পোশাক, কৃষিপণ্য, পাটজাত দ্রব্য ও হোম টেক্সটাইল খাতে এই ধস সবচেয়ে বেশি। বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলমান অর্থনৈতিক মন্দায় আরও ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। বিবিএসের হিসাবে, দেশের দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ২১.২ শতাংশ, যা এক বছরে প্রায় ২.৫ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন দেশের অর্থনীতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক সংকটেও নিমজ্জিত। ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেলে খরচ কমে, চাহিদা কমে, উৎপাদন ও কর্মসংস্থানও হ্রাস পায়। তাদের মতে, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই দরকার মজুরি বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নীতি, বাজার ও সরবরাহ চেইন ব্যবস্থার সংস্কার, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য ও নগদ সহায়তা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।
