ফরিদপুরে ‘ইসলাম পরিপন্থী’ আখ্যায় ঐতিহ্যবাহী বিচারগানের আসর বন্ধ, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে ক্ষোভ

২৪ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের গ্রামীণ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, লোকসংগীতের ঐতিহ্যবাহী ধারা ‘বিচারগান’-এর একটি আসরকে ‘ইসলাম পরিপন্থী’ আখ্যা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের রসুলপুর বাজারে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান শুরুর ঠিক আগমুহূর্তে এই হস্তক্ষেপ ঘটে। উগ্রবাদীদের হুমকি-ধমকিতে নতজানু প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তে স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী ও আয়োজকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, যা সামাজিক মাধ্যমেও ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে। বিচারগান বাংলাদেশের গ্রামীণ লোকসংগীতের এক জনপ্রিয় ধারা, যেখানে গান, সংলাপ ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সামাজিক, নৈতিক বা ধর্মীয় বিষয়গুলোকে উপস্থাপন করা হয়। এটি শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য, যা গ্রামীণ সমাজে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন তোলে এবং শিক্ষামূলক বার্তা দেয়। স্থানীয় সূত্র অনুসারে, রসুলপুর বাজারে ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সোলেমান ফকিরের উদ্যোগে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দুই দিন ধরে এলাকায় মাইকিং চলেছে, স্থানীয়দের উদ্যোগে প্যান্ডেল ও মঞ্চ নির্মাণের পর সব প্রস্তুতি শেষ। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগে ইউএনও দবির উদ্দিন ঘটনাস্থলে পৌঁছে বন্ধের নির্দেশ দেন, ফলে প্যান্ডেল খুলে ফেলা হয়। আয়োজক সোলেমান ফকির বলেন, “স্থানীয়দের অনুরোধেই আমি এই আয়োজন করেছিলাম। এটা আমাদের এলাকার পুরোনো ঐতিহ্য, যা শতাব্দী ধরে চলে আসছে। কিন্তু হুজুররা এটাকে ‘যাত্রাপালা’ বলে প্রচার করে ইউএনও সাহেবের কাছে অভিযোগ করে দেন। ফলে আমাদের সব শ্রম নষ্ট হয়ে গেল।” তিনি আরও জানান, অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ বিনোদনমূলক ছিল। এতে কোনো ধর্মীয় কোনো বিষয়ই ছিল না। ইউপি সদস্য সোলেমান ফকির জানান, আয়োজনের ব্যাপারে তিনি ইউএনও ও ওসির কাছ থেকে মৌখিক অনুমতি নিয়েছিলেন। যদিও নগরকান্দা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম বলেন, ‘বিচারগান আয়োজনের জন্য আমাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।’ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে ইউএনও দবির উদ্দিন বলেন, “এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়, যা জেলা প্রশাসক প্রদান করেন। এটি একদিনের অনুষ্ঠান হওয়ায় প্রথমে আমরা তেমন গুরুত্ব দিইনি। কিন্তু বুধবার বিকেলে দেড়শতাধিক ‘হুজুর’ আমার অফিসে এসে জানান এই আয়োজন ইসলাম পরিপন্থী। বন্ধ না করলে এলাকায় আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। নিরাপত্তা বিবেচনায় আমরা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিই।” তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে অনুরূপ অনুষ্ঠানের জন্য কঠোর অনুমোদন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। প্রশাসনের এমন সংস্কৃতিবিরোধী অবস্থান স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। একজন স্থানীয় শিল্পী নাম গোপন রেখে বলেন, “বিচারগান আমাদের সংস্কৃতির অংশ, যা ধর্মীয় বিষয়েও যুক্তিযুক্ত আলোচনা করে। এটাকে পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করে বন্ধ করা অসহিষ্ণুতার লক্ষণ।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্ক চলছে, যেখানে অনেকে প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে ‘মৌলবাদী চাপের ফল’ বলে সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ দাবি করছেন যে, এমন ঐতিহ্য রক্ষার জন্য সরকারী স্তরে হস্তক্ষেপ দরকার। ফরিদপুরের এই ঘটনা বাংলাদেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রতি সতর্কতার সংকেত। ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীতের মতো নিরীহ অনুষ্ঠানগুলো ধর্মীয় সংবেদনশীলতার নামে বাধাগ্রস্ত হলে গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য কোথায় যাবে? স্থানীয় প্রশাসন এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেয়নি, কিন্তু আয়োজকরা ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠান চালানোর পরিকল্পনা করছেন। এ ঘটনা সারাদেশে সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার প্রশ্ন তুলেছে।