নিজস্ব উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থতায় এবার দুবাই ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ থেকে আমদানি-নির্ভর দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ গত প্রায় দেড় বছরে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ ছিল বাংলাদেশ। সরকারি মজুদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে সংগ্রহ করা হতো চাল। কিন্তু বিগত ১৪ মাসে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে চাল সংগ্রহের মাত্রা এতটাই বেড়েছে যে, এ নিয়ে চলছে সমালোচনা। বিশেষ করে ভারত থেকে দফায় দফায় এসেছে বিপুল পরিমাণ চাল। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে চাল সংগ্রহের ব্যর্থতা ও ভারত থেকে আমদানি কমাতে অন্তর্বর্তী সরকার মিয়ানমার ও দুবাই (আরব আমিরাত) থেকে মোট ১ লাখ টন চাল ক্রয়ের অনুমোদন দিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির সদর দপ্তর (এসিসিজিপি) আজ মঙ্গলবার এই চুক্তি অনুমোদন করে। কিন্তু এই পদক্ষেপ সত্ত্বেও, দুবাইয়ের চাল মূলত ভারতীয় সরবরাহকারী থেকেই আসছে বলে সূত্র জানিয়ছে। এতে নির্ভরতা আদৌ কমছে কিনা তা সন্দেহজনক। অন্যদিকে, মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নাজুক সম্পর্ক সত্ত্বেও চাল আমদানি চালিয়ে যাওয়া কূটনৈতিক ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এসিসিজিপির সভায় অনুমোদিত প্রস্তাব অনুসারে, খাদ্য অধিদপ্তর ৫০,০০০ টন নন-বাসমতি সেদ্ধ চাল দুবাইয়ের এম/এস ক্রেডেন্টওয়ান এফজেসিও কোম্পানি থেকে আমদানি করবে। এর মোট খরচ ২১৬.৯০ কোটি টাকা, যার হার টনপ্রতি ৩৫৫.৯৯ ডলার। একইসঙ্গে, মিয়ানমার রাইস ফেডারেশন (এমআরএফ) থেকে ৫০,০০০ টন আতব চাল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার খরচ ২২৯.৩২ কোটি টাকা এবং হার টনপ্রতি ৩৭৬.৫০ ডলার। মোট খরচ প্রায় ৪৪৬.২২ কোটি টাকা। এই আমদানি জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) এবং আন্তর্জাতিক টেন্ডারের মাধ্যমে হবে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাজার স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। ভারত-নির্ভরতা কমানোর প্রচেষ্টা: কতটা কার্যকর? অন্তর্বর্তী সরকারের খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মাজুমদার জানান, “এই বছর মোট ৯ লাখ টন চাল আমদানির লক্ষ্য রয়েছে, যাতে ভারত ছাড়াও পাকিস্তান, মিয়ানমারসহ অন্যান্য উৎস থেকে সোর্সিং করা হবে।” গত বছর ভারত থেকে ২৬,৯৩৫ টন সেদ্ধ চাল আমদানি হয়েছে, যা দেশের চাল আমদানির বড় অংশ। কিন্তু ভারতের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের কারণে দাম বেড়েছে, তাই বৈচিত্র্যকরণ জরুরি। তবে, দুবাইয়ের চাল আমদানির ব্যাপারে প্রশ্ন উঠেছে। আরব আমিরাত নিজে চাল উৎপাদন করে না; তারা মূলত ভারত (৩৮৯,১৫,০০০ মেট্রিক টন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে) এবং পাকিস্তান থেকে আমদানি করে। দুবাইয়ের জেবেল আলি বন্দর চালের বড় পুনঃরপ্তানি হাব, যা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং সিআইএস দেশগুলোতে পুনরায় রপ্তানি করে। ক্রেডেন্টওয়ান এফজেসিওর মতো কোম্পানিগুলো ভারতীয় বাসমতি এবং নন-বাসমতি চালের বড় আমদানিকারক। ফলে, এই আমদানি যদিও ‘দুবাই থেকে’ বলা হচ্ছে, তা পরোক্ষভাবে ভারত-নির্ভরতা বাড়াতে পারে। মিয়ানমারের সাথে নাজুক সম্পর্ক: রোহিঙ্গা ইস্যুর ছায়া মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি চালিয়ে যাওয়া কূটনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। বাংলাদেশে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে, যারা ২০১৭ সাল থেকে রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে। সম্পর্ক নাজুক হলেও, ‘রাইস ডিপ্লোম্যাসি’ হিসেবে এই বাণিজ্য চলছে। সেপ্টেম্বরে ২ লাখ টন চাল রপ্তানির চুক্তি হয়েছে, এবং মিয়ানমার আরও সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। রাখাইনের চাল উৎপাদন কমলেও (৮৫০,০০০ একর চাষ), এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে পারে। তবে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হওয়ায় (২০১৮-১৯ এবং পরবর্তী চেষ্টা) সম্পর্কে উত্তেজনা রয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ সম্প্রতি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য দেশীয় সম্পদ আর বরাদ্দ করা সম্ভব নয়—আন্তর্জাতিক রোডম্যাপ দরকার। বাজার স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে আরও পদক্ষেপ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, এই আমদানি বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করবে এবং খাদ্য সংকট মোকাবিলা করবে। গত অক্টোবরে ভারত থেকে আমদানির পর দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু বোরো মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা (৫ লাখ টন ধান) পূরণে ব্যর্থতার কারণে আমদানি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং পাকিস্তান, থাইল্যান্ডের মতো উৎস বৈচিত্র্যকরণ দরকার। কিন্তু দুবাইয়ের মাধ্যমে ভারতীয় চাল আসলে এটি কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার বিষয়। রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া কি ‘ডিপ্লোম্যাসি’র অংশ, নাকি ঝুঁকিপূর্ণ—এ নিয়ে বিতর্ক চলছে।