কী ঘটছে সেন্ট মার্টিন্সে? পরিবেশ রক্ষার নামে ধ্বংসলীলা আর বিশেষ উদ্দেশ্যে জনমানবহীন করাই লক্ষ্য?

২৩ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন্স এখন পরিবেশ রক্ষার নামে ‘নিষিদ্ধ এলাকা’য় পরিণত হচ্ছে। আজ বুধবার পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ-২ শাখা থেকে জারি ১২টি কঠোর নির্দেশনা দ্বীপের ভ্রমণকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। কিন্তু এই নিয়মের পেছনে কি শুধু পরিবেশ রক্ষা, নাকি ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ এবং গোপন ষড়যন্ত্র রয়েছে? স্থানীয় হোটেল-রিসোর্ট মালিকরা জায়গাজমি কমদামে বেচে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাচ্ছেন, আর বছরে মাত্র ৩ মাসের আয়ে ব্যবসা চালানোর স্বপ্ন দেখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাকি ৯ মাস দ্বীপকে ‘জনমানুষশূন্য’ করার এই পরিকল্পনা কি তবে বিদেশি হাতের খেলা? বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত কোরাল রিফ—অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ (জিবিআর)—এর উদাহরণ দেখলে সন্দেহ আরও গাঢ় হয়: সেখানে কি পর্যটন বন্ধ করে কোরাল সংরক্ষণ করা হয়েছে? না, বরং কঠোর নিয়মাবলীতে নিয়ন্ত্রিত পর্যটন চালিয়ে রিফকে সংরক্ষণ করা হয়েছে, যা বছরে লক্ষ লক্ষ পর্যটক আকর্ষণ করে এবং সংরক্ষণে অবদান রাখে। ইউনূস সরকারের প্রজ্ঞাপনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) সেন্ট মার্টিন্সে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি দিতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টাল থেকে অনলাইনে টিকিট ক্রয় বাধ্যতামূলক—প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোড থাকবে, অনুপস্থিতিতে তা নকল গণ্য হবে। ভ্রমণের সময়সূচি ও পর্যটক উপস্থিতি কঠোর নিয়ন্ত্রণে: প্রতিদিন গড়ে ২,০০০-এর বেশি পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ। নভেম্বরে শুধু দিনের ভ্রমণ, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে রাত্রিযাপনের অনুমতি—ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী ৯ মাস সম্পূর্ণ বন্ধ। এছাড়া পলিথিন নিষিদ্ধ, মোটরচালিত যানবাহন বারণ, সৈকতে আলো জ্বালানো বা বারবিকিউ নিষেধাজ্ঞা—সব মিলিয়ে দ্বীপটি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ‘আদর্শ’ হবে বলে সরকারের দাবি। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই নির্দেশনাকে ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ বলে অভিহিত করছেন। সেন্ট মার্টিন্স হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শিবলী আজম কোরেশি বলেন, “বছরে মাত্র ৩ মাস (নভেম্বর-জানুয়ারি) পর্যটন মৌসুমে ৯০% আয় হয়। বাকি ৯ মাস বন্ধ হলে কীভাবে ব্যবসা চলবে? দামি জায়গা কমদামে বিক্রি করে আমরা চলে যাচ্ছি—এটাই কি পরিবেশ রক্ষা?” তিনি জানান, দ্বীপে প্রায় ১৫০টি হোটেল-রিসোর্ট রয়েছে, যাদের মোট বিনিয়োগ ১,৫০০ কোটি টাকারও বেশি। নতুন নিয়মে ৩ লক্ষ মানুষের জীবিকা (হোটেল, জাহাজ, শুঁটকি-ডাব বিক্রেতা) বিপন্ন। ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) দাবি করেছে, এতে পর্যটন শিল্পের বিনিয়োগ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা না হলে আন্দোলন হবে। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপ পরিবেশ ও পর্যটন রক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান শিবলুল আজম কোরেশি আরও অভিযোগ করেন, “দ্বীপকে জনশূন্য করার পেছনে গোপন ষড়যন্ত্র চলছে। বিদেশি কোম্পানিগুলো এখানে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়—পরিবেশ রক্ষার নামে স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে ‘প্লাস্টিক ফ্রি ইকো ট্যুরিজম’ প্রকল্প চালু করেছি, কিন্তু সরকার কেন এতে সহযোগিতা করছে না?” বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ধারা ১৩ অনুসারে ২০২৩-এর নির্দেশিকায় এই নিয়ম প্রণীত হলেও, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত পর্যটন কোরাল রিফ ধ্বংস করেছে, কিন্তু সম্পূর্ণ বন্ধের পরিবর্তে নিয়ন্ত্রিত পর্যটনই সমাধান। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেখানে পর্যটন সম্পূর্ণ বন্ধ না করে ‘রেসপনসিবল রিফ প্র্যাকটিসেস’ (যেমন: অ্যাঙ্করিং নিষেধ, কোরাল টাচ না করা, পারমিট-ভিত্তিক অপারেশন) চালু করে বছরে ২ মিলিয়ন পর্যটককে আকর্ষণ করা হয়েছে, যা রিফের মনিটরিং এবং পুনরুদ্ধারে সরাসরি সাহায্য করে। এখানে পর্যটকরা ‘আই অন দ্য রিফ’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে কোরাল ব্লিচিং মনিটর করে, এবং ট্যুর অপারেটররা কোরাল প্ল্যান্টিং-এ অংশ নেয়—যা অর্থনৈতিকভাবে ৫.২ বিলিয়ন ডলার আয় এবং ৬৪,০০০ চাকরি সৃষ্টি করে, সেইসঙ্গে রিফের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। সেন্ট মার্টিন্সের মতো সম্পূর্ণ বন্ধের পরিবর্তে এমন মডেল কেন গ্রহণ করা যায় না? পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “সেন্ট মার্টিন্স আমাদের জাতীয় সম্পদ। অতিরিক্ত পর্যটন এর ধ্বংস ডেকেছে—এই নির্দেশনা দিয়ে আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাঁচাচ্ছি।” কিন্তু ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলছেন: পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয়দের জীবিকা বলিদান কেন? গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের সাফল্য দেখিয়ে তারা বলছেন, নিয়ন্ত্রিত পর্যটনই উত্তম পথ—সম্পূর্ণ বন্ধ নয়। সরকারের এই পদক্ষেপ কি সত্যিই টেকসই, নাকি অর্থনৈতিক ধ্বংসের প্রয়োজন? দ্বীপবাসীরা অপেক্ষায়—যাতে তাদের স্বপ্নিল দ্বীপ শুধু পরিবেশের নয়, জীবিকারও আশ্রয় হয়।