গভীর সংকটে পুঁজিবাজার: বাজার ছেড়েছেন ৮২ হাজার বিনিয়োগকারী, বাড়ছে আস্থাহীনতা ও হতাশা

২৩ অক্টোবর, ২০২৫ | ৬:৩২ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

দেশের শেয়ারবাজারে ফের নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতার ঘন ছায়া। একসময় নতুন বিনিয়োগকারীদের পদচারণায় সরব ছিল বাজার, আজ সেই বাজার প্রায় নিস্তব্ধ। টানা দরপতন, নীতিগত অস্থিরতা ও দীর্ঘমেয়াদি মন্দার চাপে বিনিয়োগকারীরা একে একে সরে যাচ্ছেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি বিদেশিরাও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশের পুঁজিবাজার থেকে। বাজারে এখন মুনাফার চেয়ে ক্ষতির খবরই বেশি। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, অনেকেই দ্রুত হিসাব বন্ধ করে বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আস্থা ফেরাতে এখন শুধু ঘোষণায় হবে না—দরকার বাস্তব ও কার্যকর পদক্ষেপ। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা, ন্যায্য মূল্যায়ন এবং বাজারে তারল্য নিশ্চিত না করলে এ ধস ঠেকানো কঠিন। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য বলছে, সক্রিয় বিও (বেনেফিশিয়ারি ওনার্স) অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমেছে ৫০ হাজারের বেশি। এর বাইরে আরও প্রায় ৩২ হাজার অ্যাকাউন্টে কোনো শেয়ার নেই। ২০২৪ সালের শেষে মোট বিও হিসাব ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫২টি। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা নেমে এসেছে ১৬ লাখ ৩২ হাজার ২২৭টিতে। একই সঙ্গে শেয়ারশূন্য বিও হিসাব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫৯টিতে। অর্থাৎ, প্রায় ৩২ হাজার অ্যাকাউন্টে কোনো শেয়ারই নেই। এতে স্পষ্ট, বাজারে সক্রিয় বিনিয়োগকারীর সংখ্যা দ্রুত কমছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ৮২ হাজার বিনিয়োগকারী কার্যত শেয়ারবাজার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন—যা বাজারের গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করে। আরও উদ্বেগের বিষয়, বিদেশি বিনিয়োগও হ্রাস পাচ্ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত ১১টি বড় কোম্পানিতে বিদেশি শেয়ারের পরিমাণ ০.১০ শতাংশের বেশি কমেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, বেক্সিমকো ফার্মা, এমজেএলবিডি, রেনেটা, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ওয়ান ব্যাংক, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস ও বিডি থাই অ্যালুমিনিয়ামসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এই পতন বিনিয়োগকারীদের আস্থায় আরও ধাক্কা দিয়েছে। বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ব্রোকার হাউসগুলোর ওপরও। টানা লোকসানে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করছে, কিন্তু তাতেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, “মানুষের আস্থা ফেরাতে কেবল কয়েকজনকে শাস্তি দিলে হবে না। বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পেতে চান, কিন্তু যখন বারবার লোকসান হয়—তখন কেউই আর বাজারে থাকতে চায় না।” তিনি আরও বলেন, “ব্রোকার হাউসগুলোর অবস্থা ভয়াবহ। প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াই চলছে। অথচ কর্তৃপক্ষের আচরণে বোঝা যায় না যে বাজার নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে।” এদিকে, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানা পরিকল্পনার কথা জানালেও বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক কোম্পানি বাজারে আনার ঘোষণা দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের অগ্রগতি নেই। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা আরও গভীর হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুঁজিবাজার এখন এক গভীর আস্থাজনিত সংকটে রয়েছে। যতদিন না স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দীর্ঘমেয়াদি নীতির নিশ্চয়তা দেওয়া যায়, ততদিন বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরবে না। একসময় যাদের স্বপ্ন ছিল শেয়ারবাজার ঘিরে, আজ তাদের অনেকেই বলছেন—“এই বাজারে টিকে থাকা মানে ক্ষতির অপেক্ষা।” বাংলাদেশের শেয়ারবাজার তাই এখন কেবল সংখ্যার নয়, আস্থাহীনতারও প্রতিচ্ছবি।