আওয়ামী লীগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২ সুপারিশ নিয়ে ইউনূস সরকারকে ৬ মানবাধিকার সংস্থার চিঠি

২০ অক্টোবর, ২০২৫ | ৫:১৩ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারসহ ১২টি সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে যৌথভাবে খোলাচিঠি দিয়েছে ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই চিঠিতে যে ১২টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের কাছে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানানো হয়েছে, সেগুলো হলো: জবাবদিহিতা ও বিচারের নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা খাতে সংস্কার, গুমের অপরাধ শনাক্তকরণ ও তদন্ত কমিশন শক্তিশালীকরণ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের পুনর্গঠন, ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায় আইন সংস্কার, ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও নজরদারি সীমিতকরণ, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার, আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সুশীল সমাজ ও এনজিওর স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সহযোগিতা। চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে ছয়টি আন্তর্জাতিক সংস্থা— সিভিকাস, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), ফর্টিফাই রাইটস, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট। চিঠিতে ২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে মানবাধিকার সুরক্ষায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেখানে বলা হয়, “নির্বাচনের আগে অল্প সময়ের এই অন্তর্বর্তী সময়ে আমরা আপনাকে আহ্বান জানাই মানবাধিকার সুরক্ষা আরও বিস্তৃত করতে এবং বাংলাদেশে এমন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে, যা স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে পুনরায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের ঝুঁকি প্রতিহত করবে।” সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে জানায়, নিরাপত্তা খাতে কাঠামোগত সংস্কার এখনো হয়নি এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য জবাবদিহিতা ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ সহযোগিতা করছে না। চিঠিতে আরও বলা হয়, “চলমান নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট যেসব মামলার যথাযথ প্রমাণ নেই বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়—তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।” রোহিঙ্গা ইস্যুতেও সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চিঠিতে জাতিসংঘের রোহিঙ্গা বিষয়ক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “আপনি বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান হচ্ছে স্বদেশ প্রত্যাবাসন এবং ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ হিসেবে নতুন আগত শরণার্থীদের ‘ফিরে যেতে দিতে হবে’। রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে তাদের স্বদেশে ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে এসেছে। কিন্তু ২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে আসা প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গাসহ কারও জন্যই বর্তমানে মিয়ানমারে নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ নেই।” চিঠির শেষাংশে বাংলাদেশে বসবাসরত সকল নাগরিকের অধিকার, নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা সুরক্ষার জন্য উপরে উল্লিখিত ১২ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। মানবাধিকার রক্ষায় ১২ দফা প্রস্তাব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্দেশে যে ১২ দফা সুপারিশ উত্থাপন করা হয়েছে, তাতে জবাবদিহিতা, মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের সংস্কার ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১. জবাবদিহিতা ও বিচারের নিশ্চয়তা: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ইতোমধ্যে সেনা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। সেনাবাহিনীকে এই প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণ সহযোগিতা করতে হবে এবং বেসামরিক আদালত হিসেবে ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারকে সম্মান জানাতে হবে। পাশাপাশি আইসিটির স্বাধীনতা, আইনি কাঠামো ও সম্পদ আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে সাময়িক স্থগিতাদেশ দেওয়া উচিত। ২. নিরাপত্তা খাতে সংস্কার: র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) বিলুপ্ত করা এবং সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইয়ের ক্ষমতা সীমিত করা জরুরি বলে সংস্থাগুলোর অভিমত। তাদের মতে, র‍্যাবের অতীত কর্মকাণ্ড—বিশেষত নির্যাতন, হত্যা ও গুমের অভিযোগ—এই বাহিনীকে সংস্কারের বাইরে নিয়ে গেছে। তাই সব সামরিক সদস্যকে বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে প্রত্যাহার করতে হবে এবং ডিজিএফআইয়ের কার্যক্রমকে কেবল সামরিক গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। ৩. গুমের অপরাধ নির্ধারণ ও তদন্ত কমিশন শক্তিশালীকরণ: আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী গুমকে স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে এবং ‘গুম প্রতিরোধ ও প্রতিকার অধ্যাদেশ’ অবিলম্বে পাস করতে হবে—তবে মৃত্যুদণ্ডবিহীনভাবে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। গঠিত কমিশনকে পর্যাপ্ত সময়, বাজেট ও তদন্তের পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। ৪. জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (এনএইচআরসি) সংস্কার: ‘প্যারিস প্রিন্সিপল’-এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এনএইচআরসিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে হবে। কমিশন যেন নিরাপত্তা বাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে—সেটি নিশ্চিত করতে হবে। ৫. ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষায় আইন সংস্কার: ২০২৫ সালের ‘সাইবার সিকিউরিটি অধ্যাদেশ’সহ সব দমনমূলক আইন—যেমন সন্ত্রাসবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও ফৌজদারি আইনে মানহানির ধারা—আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মান অনুযায়ী সংশোধন বা বাতিল করতে হবে। সংস্থাগুলোর মতে, ২০২৩ সালের আইনটি বাতিল হলেও নতুন অধ্যাদেশে এমন কিছু অস্পষ্ট ধারা রয়ে গেছে, যা ক্ষমতার অপব্যবহারকে উৎসাহিত করতে পারে। ৬. ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা ও নজরদারি সীমিতকরণ: ‘পারসোনাল ডাটা প্রোটেকশন’ ও ‘ন্যাশনাল ডাটা ম্যানেজমেন্ট’ অধ্যাদেশের খসড়া আন্তর্জাতিক মান অনুসারে পুনর্বিবেচনা করা উচিত, যাতে নাগরিকদের গোপনীয়তা রক্ষা পায় এবং রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত ক্ষমতা সীমিত থাকে। ৭. মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিক সুরক্ষা: সংবাদকর্মীদের হয়রানি, গ্রেপ্তার বা রাজনৈতিক পক্ষপাতের অভিযোগে হামলা থেকে রক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। ৮. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার: আগস্ট ২০২৪-এর আগে ও পরে দায়ের হওয়া সব রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা পর্যালোচনা করে বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে। যেসব মামলার কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই, সেগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে। ৯. আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর আরোপিত সামগ্রিক নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনগুলো। তাদের মতে, এটি গণতন্ত্র ও বহুদলীয় রাজনীতির পথে বড় বাধা। জাতিসংঘের ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “গণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বার্থে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।” ১০. সিভিল সোসাইটি ও এনজিওর স্বাধীনতা: এনজিও বিষয়ক ব্যুরো সংস্কার করে তা যেন নাগরিক সংগঠনগুলোকে হয়রানি বা বিদেশি অর্থায়নে বাধা দেওয়ার হাতিয়ার না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইনও পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। ১১. রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষা: রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে হবে। ক্যাম্পে চলাচল, জীবিকা ও শিক্ষার ওপর আরোপিত সীমাবদ্ধতা শিথিল করতে হবে, যাতে তাদের মর্যাদা ও আত্মনির্ভরতা বজায় থাকে। ১২. আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সঙ্গে সহযোগিতা: বাংলাদেশ-মিয়ানমার ইস্যুতে আইসিসির চলমান তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতের জারি করা ওয়ারেন্টে অভিযুক্ত কেউ বাংলাদেশে অবস্থান করলে তাকে হস্তান্তর করতে হবে।