বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা: ১৪ জন সিনিয়র অফিসারের গ্রেপ্তারের পর জেনারেল ওয়াকার এর অন্তর্ধান নিয়ে সন্দেহের ঘনঘটা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চলমান সংকটের মধ্যে নতুন করে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) নির্দেশে ১৪ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করার পর সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ওয়াকার-উজ-জামানের সৌদি আরব সফর বাতিল হয়েছে। এরপর থেকে তাঁর অবস্থান নিয়ে সন্দেহ এবং জল্পনা বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব অনুসারে, জেনারেল ওয়াকার সম্ভবত কুমিল্লা সেনানিবাসে নিরাপদ হেফাজতে রয়েছেন এবং প্যারা কমান্ডোরা তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। এই ঘটনা সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিয়ে জনগণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে। আইসিটির ৮ অক্টোবরের নির্দেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৩২ জনের মধ্যে ২৫ জন বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এর মধ্যে ১৪ জন সক্রিয় কর্মকর্তা (একজন অবসরপ্রাপ্তের ছুটিতে থাকা অবস্থায়) সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল মেজর জেনারেল এমএইচ হাকিমুজ্জামান গত শনিবার ঢাকা সেনানিবাসে সংবাদ সম্মেলনে জানান, এই গ্রেপ্তারগুলো আইনি প্রক্রিয়ার অংশ এবং সেনাবাহিনী ন্যায়বিচারের পক্ষে। কিন্তু মেজর জেনারেল কবির আহমেদের অন্তর্ধান এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই গ্রেপ্তারের পরিণতিতে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ১৪ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল চার দিনের সৌদি আরব সফর বাতিল করে দেন। এই সফরে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশি সেনাদের সম্ভাব্য নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। এর আগে ১২-১৪ অক্টোবরের জন্য নির্ধারিত ভারত সফরও বাতিল হয়েছে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, এই সিদ্ধান্তের পিছনে গ্রেপ্তারের ঘটনায় সেনাবাহিনীর মধ্যে বাড়তে থাকা অসন্তোষ এবং সম্ভাব্য অস্থিরতা রোধ করার উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে জেনারেল ওয়াকারের কোনো সরকারি হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি ঢাকা আছেন নাকি ঢাকা ছেড়ে অন্য কোন সেনানিবাসে নিরাপদ আশ্রয়ে গেছেন, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র জল্পনা চলছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক গুজব হলো—জেনারেল ওয়াকার কুমিল্লা সেনানিবাসে নিরাপদ হেফাজতে রয়েছেন। স্থানীয় সূত্র এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, প্যারা কমান্ডো বাহিনী তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে এবং এটি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা। এই সন্দেহগুলো সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডে নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব নির্দেশ করছে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে কিছু অফিসারের মধ্যে এই গ্রেপ্তার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে, যা সেনাপ্রধানের অবস্থান নিয়ে সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জনগণের মধ্যে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি এখনও তাজা, যেখানে সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব দেশকে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছিল, তারা আজ নিজ নিজ স্বার্থে বিভক্ত, কেউই লাইন অব কমান্ড এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজারো নাগরিক লিখছেন, “আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে ফিরে চাই—কমান্ডের অধীনে এবং শৃঙ্খলার মধ্যে। এই সন্দেহ এবং গুজব দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। সেনাবাহিনীকে রাজনীতির বাইরে রেখে পেশাদারিত্বের পথে ফিরিয়ে আনতে হবে, নইলে জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।” একজন নাগরিক লিখেছেন, “সেনাপ্রধানের অন্তর্ধান নিয়ে যদি এমন গুজব চলে, তাহলে সাধারণ সেনারা কীভাবে আস্থা রাখবে? দেশের স্থিতিশীলতার জন্য সেনাবাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখুন।” সরকারি সূত্রগুলো এখনও জেনারেল ওয়াকারের অবস্থান নিয়ে কোনো স্পষ্টতা দেননি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এই সংকট মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন, এই অস্থিরতা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ না করলে আসন্ন নির্বাচন এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। জনগণের দাবি স্পষ্ট—সেনাবাহিনীকে তার পেশাদার দায়িত্বে ফিরিয়ে আনুন, যাতে দেশ স্থিতিশীলতা পায়।