হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রযোজনায় মানবাধিকার লংঘন

গত বছর ৫ই আগস্ট বাংলাদেশের সেনাবাহিনী কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জোরপূর্বক ভারতে পাঠানোর চৌদ্দ মাস দুইদিন পর ৮ই অক্টোবর তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালতে গুম করা, গোপনে বন্দী রাখা ও নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দুইটি ফরমাল চার্জ বা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। এর একটিতে শেখ হাসিনাসহ ১৭ জন এবং অন্যটিতে শেখ হাসিনাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। উভয় মামলায়ই আদালত আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। দুটি মামলায় মোট ৩০ জন আসামির মধ্যে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও কর্মরত ২৫ জন কর্মকর্তার নাম রয়েছে, তন্মধ্যে ১৩ জন কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত। উল্লিখিত অভিযোগ দাখিলের একদিন পূর্বে অর্থাৎ ৬ই অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ আইনটিতে নতুন একটি ধারা সংযোজন করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সংযোজিত ধারায় বলা হয়েছে, “জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারো বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল হলেই তিনি আর জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। এমনকি তিনি কোনো সরকারি চাকরিও করতে পারবেন না।” অতএব, অভিযোগে উল্লিখিত সেনাবাহিনীর কর্মরত ১৩ জন কর্মকর্তার চাকুরী ৮ই অক্টোবর, ২০২৫ অপরাহ্ন থেকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি পাবেন। তাতে কী প্রতীয়মান হচ্ছে? ট্রাইব্যুনাল আদালতে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল হলেই তিনি দোষী সাব্যস্ত হবেন ও শাস্তি পাবেন। কিন্তু, বিচারকাজ শেষে যদি প্রমাণিত হয় যে, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল হলো তিনি নির্দোষ, দাখিলীয় অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করণে প্রসিকিউশন ব্যর্থ হয়েছে, তখন নতুন সংযোজিত ধারায় অভিযোগ দাখিলের পরপরই দেয়া শাস্তিটি অবশ্যই অযৌক্তিক ও মানবাধিকার পরিপন্থী হবে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) ধারা ১১(১) অনুযায়ী ‘নির্দোষতার অনুমান’ একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। এই নীতি আন্তর্জাতিক মানবিকতার আইনের (আইএইচএল) একটি মূল নীতি হিসেবে উল্লেখিত আছে। ‘নির্দোষতার অনুমান’ কখন করবেন, কেন করবেন? আইনি নীতি অনুসারে, যেকোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি সন্দেহাতীতভাবে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচিত হবে। আদালতে ‘সন্দেহাতীতভাবে অভিযোগ প্রমাণ করা না গেলে অভিযুক্ত ব্যক্তি খালাস পাবেন। অতএব, যেকোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাজা বা শাস্তি প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে আদালতের কাছে অপরাধটি অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক সংঘটিত হয়েছে মর্মে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস করাবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞ আদালতের কাছে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির দ্বারা অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে মর্মে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্বাস না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আদালতের কাছে দাখিলীয় অভিযোগের ব্যক্তিকে নির্দোষ বলে বিবেচনায় রাখবেন। এখানে আমরা বলতে পারি, উল্লিখিত দুটি মামলায় কর্মরত ১৩ জন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার অভিপ্রায়ে অভিযোগ দাখিলের একদিন পূর্বে আইন মন্ত্রণালয় আইসিটি আইনের সংশোধনীর প্রজ্ঞাপন জারী করেছে। এটি পরিপূর্ণভাবে মানবিকতার লঙ্ঘন। এখন আসুন, যৌথ প্রযোজনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা কেন এসেছে? দেখুন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পরপরই নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি সন্তোষ প্রকাশ করে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখার শিরোনাম করেছেন— ‘ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগোল বাংলাদেশ’। কথাটি যথাযথ হতো, যদি অভিযোগ দাখিলের একদিন পূর্বে আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক আইনে সংযোজন করা বিতর্কিত প্রজ্ঞাপন জারীর বিষয়টি না ঘটতো। কিন্তু, অভিযোগ দাখিলের পরই, বিচার শুরুর পূর্বেই যেনো আসামী শাস্তি পায়, তেমন বিধান করে যেহেতু আইন মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারী করেছে, সেহেতু এটিকে ন্যায় বিচারের পথে একধাপ এগিয়েছে বলা যাবে না, বরং আড়াইশ বছর পিছিয়েছে বলতে হবে। এখন কথা হলো, এমন যৌক্তিক প্রসঙ্গটি একটি মানবাধিকার সংগঠনের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে না। অতএব, অভিযোগ পত্র দাখিল ও গ্রেফতারী পরোয়ানা জারীর পরপরই নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি এবং বাংলাদেশের আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক অভিযোগ দাখিলের পরই অর্থাৎ বিচার শুরুর পূর্বেই শাস্তির বিধান আরোপ করে আইন করণের ঘটনায় যেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে, তাতে উভয়ের যোগসূত্র রয়েছে বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান হচ্ছে। গোলাম হোসেন আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী