তীব্র শব্দে বিভিন্ন জাতির বিনাশ ও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা

৯ অক্টোবর, ২০২৫ | ১১:০২ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে পূর্ববর্তীদের জাতিদের ধ্বংসের বিবরণ এসেছে। আল্লাহর শাস্তিতে ধ্বংস হয়েছে আদ ও সামুদ জাতি এবং লুত ও নুহ (আ.)-এর সম্প্রদায়। এর মধ্যে একটি জাতিকে আল্লাহ তীব্র শব্দ দ্বারা ধ্বংস করেছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, শব্দ কিভাবে এক জাতির ধ্বংসের কারণ হতে পারে? আসুন জেনে নেই, কারা তীব্র শব্দের কারণে ধ্বংস হয়েছিল, তাদের অপরাধ কী ছিল, কিভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল এবং আধুনিক বিজ্ঞান এই বিষয়ে কী বলে? তীব্র শব্দে যারা ধ্বংস হয়েছিল মহান আল্লাহ তীব্র শব্দে সামুদ জাতি, লুত (আ.)-এর সম্প্রদায় ও মাদায়েনের অধিবাসীদের ধ্বংস করেছিলেন। এর মধ্যে সামুদ জাতি শুধু তীব্র শব্দে ধ্বংস হয়েছিল এবং মাদায়েনের অধিবাসীরা তীব্র শব্দ ও ভূকম্পনে ধ্বংস হয়েছিল। উভয় সম্প্রদায় পাহাড়ে বসতি স্থাপন করেছিল। ক. মাদায়েনের অধিবাসী : মাদায়েনের অধিবাসীরা ছিল নবী শোয়াইব (আ.)-এর সম্প্রদায়। তারা পাহাড়ে বসবাস করত। তাদের আগমন হয়েছিল লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের পর এবং সামুদ জাতির পর। প্রাচীন মাদায়েনের অবস্থান ছিল আধুনিক সৌদি আরবের বিদা শহরে, যা দেশটির উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের আফাল উপত্যকায় অবস্থিত। অঞ্চলটির অবস্থান তাবুক, আকাবা উপসাগর ও লোহিত সাগরের মাঝে। মাদায়েনের অধিবাসীদের আচরণ ছিল নিকৃষ্ট। তারা মানুষকে ওজনে কম দিত, কিন্তু নিজেরা নেওয়ার সময় বেশি নিত। আল্লাহ শোয়াইব (আ.)-কে প্রেরণ করেন। তিনি তাদের আল্লাহর ওপর ঈমান আনতে এবং মন্দ স্বভাব ত্যাগ করার আহ্বান জানান। কিন্তু তাদের বেশির ভাগ সেই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে। ফলে আল্লাহ তাদেরকে তীব্র শব্দে ধ্বংস করে দেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমার নির্দেশ এলো তখন আমি শোয়াইব ও তার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম। অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল। ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় পড়ে রইল।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৯৪) অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তার সম্প্রদায়ের অবিশ্বাসী প্রধানরা বলল, তোমরা যদি শোয়াইবকে অনুসরণ করো তবে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অতঃপর তারা ভূমিকম্প দ্বারা আক্রান্ত হলো। ফলে তাদের সকাল হলো নিজ ঘরে অধঃমুখে পতিত অবস্থায়।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ৯০-৯১) খ. সামুদ জাতি : সামুদ জাতি ছিল নবী সালেহ (আ.)-এর সম্প্রদায়। তারা আরব বংশোদ্ভূত ছিল। আধুনিক সৌদি আরবের হিজাজ অঞ্চলে সামুদ জাতি বসবাস করত। স্থানটিকে বর্তমান নাম মাদায়েনে সালেহ। সামুদ জাতি শিরক, কুফর, জুলুমসহ নানা ধরনের অপরাধে লিপ্ত ছিল। তারা সালেহ (আ.)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং আল্লাহর কুদরতি উটনিকে হত্যা করেছিল। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন আমার নির্দেশ এলো তখন আমি সালেহ ও তাঁর সঙ্গে যারা ঈমান এনেছিল তাদেরকে আমার অনুগ্রহে রক্ষা করেছিলাম এবং রক্ষা করলাম সেই দিনের লাঞ্ছনা থেকে। তোমার প্রতিপালক শক্তিমান, পরাক্রমশালী। অতঃপর যারা সীমালঙ্ঘন করেছিল মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল। ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ৬৬-৬৭) গ. লুত (আ.)-এর সম্প্রদায় : লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়কে একাধিক শাস্তির মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছিল। যার একটি তীব্র শব্দ। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সূর্যোদয়ের সময়ে মহানাদ তাদেরকে আঘাত করল।’ (সুরা হিজর, আয়াত : ৭৩) যে শব্দে তারা ধ্বংস হয়েছিল পবিত্র কোরআনে মাদায়েনের অধিবাসী ও সামুদ জাতির ধ্বংসের কারণ হিসেবে ‘সায়হা’ শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। সায়হা শব্দের সাধারণ অর্থ তীব্র শব্দ। তাফসিরবিদরা দুইভাবে সায়হার ব্যাখ্যা করেছেন। তাহলো— ১. এটি শুধু শব্দ নয়, বরং অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়া। যেমন ভূমিকম্প, ঝড়, ভূমিধস, আগ্নেয়গিরি অগ্ন্যুৎপাত ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট শব্দ। তারা তাদের মতের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, মাদায়েনবাসীর ধ্বংসের কারণ হিসেবে আল্লাহ তীব্র শব্দ ও ভূমিকম্পের কথা বলেছেন। এর দ্বারা অনুমান করা যায় তারা ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট তীব্র শব্দে ধ্বংস হয়েছিল। একইভাবে সামুদ জাতির ধ্বংসের কারণ হিসেবে তীব্র শব্দ ছাড়াও (সুরা হা-মিম-সাজদার ১৭ নং আয়াতে) বজ্রাঘাতের কথা বলা হয়েছে। ২. তবে অধিকাংশ তাফসিরবিদের মত হলো ‘সায়হা’ নিছক শব্দ। সেটা অন্য কোনো কিছুর শব্দ না। তারা ভূমিকম্প ও বজ্রাঘাত সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এর দ্বারা ভূমিকম্পের শব্দের সঙ্গে এবং বজ্রাঘাতের শব্দের সঙ্গে শাস্তির শব্দকে তুলনা করা উদ্দেশ্য। শব্দও ঘাতক হতে পারে আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্লেষণ অনুসারে নিছক শব্দও মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। এমন প্রাণঘাতী শব্দ তিন প্রকার হতে পারে। যেমন— ১. Shockwaves ও Explosive Sound (বিস্ফোরণের শব্দ) : উচ্চ-তীব্রতার বিস্ফোরণ (shockwave) এতটাই শক্তিশালী হতে পারে যে, এতে মানুষের কানের পর্দা ফেটে যেতে পারে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে, এমনকি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে মৃত্যু হতে পারে। শক্তিশালী বোমার বিস্ফোরণ থেকে এটা হতে পারে। ২. Infrasound (অতি-নিম্ন শব্দতরঙ্গ) : এমন শব্দ যা মানুষ শুনতে পায় না (২০ Hz-এর নিচে), কিন্তু তা পরিবেশে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় এই কম-ফ্রিকোয়েন্সির শব্দে থাকলে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, অস্থিরতা এবং এমনকি শারীরিক ক্ষয় হতে পারে। ৩. Resonance (অনুরণন) : শব্দের কম্পন কোনো বস্তুর প্রাকৃতিক কম্পন ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে মিললে তা ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য প্রচণ্ড শব্দে কাঁচ ভেঙে যায়। যদিও তাতে কোনো কিছু সরাসরি আঘাত করে না। যদি এই ধরনের শব্দ মানুষের দেহের অভ্যন্তরীণ অংশে ‘রেসোন্যান্স’ তৈরি করে, তাহলে তা প্রাণঘাতী হতে পারে। শব্দ যেভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল শব্দ যেভাবে তাদের মৃত্যু হয়েছিল পবিত্র কোরআনের বর্ণনা এবং ঐতিহাসিক প্রমাণাদি থেকে প্রমাণিত মাদায়েন অধিবাসী ও সামুদ জাতি উভয়েই পাহাড়ে বসতি স্থাপন করেছিল। আর পাহাড়ে যে কোনো শব্দের তীব্রতা প্রকট হয়। বিশেষ করে Infrasound (অতি-নিম্ন শব্দতরঙ্গ) এখানে অতি ভয়ানক রূপ নিতে পারে। কেননা পাহাড়ে শব্দের প্রতিফলন ও প্রতিধ্বনি বেশি হয়ে থাকে। পাশাপাশি পাহাড়ি এলাকা Background noise বা জনবসতির কোলাহল থেকে মুক্ত থাকে, তাই সেখানে শব্দ ও শব্দতরঙ্গ তীব্র ও ভয়ানক হয়। বিজ্ঞানীরা বলেন, পাহাড়ের আভ্যন্তরীণ ভূকম্পনের ফলে সৃষ্ট Infrasound পাহাড়ের গুহায় বা পাহাড়ে বসতি স্থাপনকারীদের শরীরে আকস্মিক কম্পন সৃষ্টি করতে পারে। এমন ইনফ্রাসাউন্ড অঙ্গভেদি, অপ্রতিরোধ্য এবং এর ফলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায়, কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে সৃষ্ট বিস্ফোরক শব্দের কারণে সামুদ ও মাদায়েনের অধিবাসীদের মৃত্যু হয়নি, বরং তাদের মৃত্যু হয়েছিল Infrasound বা অতি-নিম্ন শব্দতরঙ্গের কারণে। যে শব্দতরঙ্গ ছিল অত্যন্ত তীব্রতর। কেননা কোরআনে বলা হয়েছে, ‘ফলে তারা নিজ নিজ ঘরে নতজানু অবস্থায় শেষ হয়ে গেল’। অর্থাত্ তাদের ঘর অক্ষত ছিল এবং অক্ষত ঘরের ভেতর তাদের দেহও অক্ষত ছিল। কিন্তু শব্দতরঙ্গের তীব্রতার কারণে তারা মৃত্যুবরণ করেছিল। (প্রকৃত কারণ ও ধরন সম্পর্কে আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন) তাফসিরে লুগাবিয়্যাতে সামুদ জাতির ওপর শাস্তির বিবরণে একটি বর্ণনা আনা হয়েছে। যা থেকে অনুমান করা যায়, আল্লাহ শাস্তি হিসেবে শব্দতরঙ্গকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন এবং তা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। এতে বলা হয়েছে, প্রথম দিন তাদের মুখমণ্ডল হলুদ হয়ে গেল যেন তাদের ওপর জাফরানের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দিন, তারা রক্তে রঞ্জিত লাল হয়ে গেল। তারা শোকে চিত্কার করে উঠল এবং শাস্তির চিহ্ন চিনতে পারল। সন্ধ্যা হলে তারা চিত্কার করে বলল, দুই দিন কি এখনও পার হয়নি? তৃতীয় দিন, তারা কালো হয়ে গেল যেন তাদের ওপর আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে।...চতুর্থ দিন যখন তারা জেগে উঠল, তখন আকাশ থেকে তাদের কাছে বজ্রপাতের মতো একটি শব্দ এলো এবং তাদের হূদপিণ্ড তাদের বুকের মধ্যে ছিঁড়ে গেল। (সুরা আরাফের ব্যাখ্যাংশ) পবিত্র কোরআনে ব্যবহূত ‘আসবাহু’ শব্দটিও অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। যা বোঝায়, তাদের মৃত্যু হয়েছিল সকালে। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, Infrasound বা অতি-নিম্ন শব্দতরঙ্গের ফলে মানবদেহে কর্টিসোল (cortisol) নামক এক ধরনের হরমোন নিঃস্বরণ হয়। এতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা ব্যাহত হয়। আর সকালেই শরীরে কার্টিসোল উত্পাদন সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে ইনফ্রাসাউন্ডের প্রভাবে সকালেই মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে। মাসরাভি ডটকম অবলম্বনে