ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও অদক্ষতায় গভীর সংকটে পর্যটন খাত: এক বছরে বিদেশি পর্যটক কমেছে ৮০%

২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৫:৩৩ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর—বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, সুন্দরবনের মতো বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, পাহাড়-উপত্যকা আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে এখানে। তবু বিদেশি পর্যটক নেই বললেই চলে। নীতিনির্ধারকেরা আশার কথা বললেও উদ্যোক্তারা একে একে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, দুর্বল প্রচারণা ও সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে পর্যটন শিল্প এখন অস্তিত্ব সংকটে। বিদেশি অতিথির অনুপস্থিতিতে একের পর এক আয়োজন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে মানসম্পন্ন রাস্তা, হোটেল-মোটেল ও আধুনিক সুবিধার অভাব স্পষ্ট। আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রচারে পরিকল্পিত উদ্যোগও নেই। চট্টগ্রাম ইপিজেডের একটি বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী বিডি ডাইজেস্ট-কে বলেন, পর্যটক মানেই তাদের কাছে টাকা আছে, তারা সেটা খরচ করতে চায়। কেন তারা বাংলাদেশে আসবে, প্রায় একই আবহাওয়া-সংস্কৃতির দেশ ভারতে না গিয়ে? বাংলাদেশ তাদের এমন কী অফার করতে পারে, যা তারা ভারতে পাবে না? ভারতে তারা একসাথে অনেক বৈচিত্রের সন্ধান পাচ্ছে, অ্যাডভেঞ্চারের সুযোগ আছে। এসব এখানে দিতে পারছি আমরা? আমাদের কি সেই বিকল্প আছে? তিনি আরও বলেন, পর্যটকরা চায় নিরাপত্তা, জীবন উপভোগের অবারিত এবং প্রশ্নমুক্ত সুযোগ। এর কিছুই নেই এখানে। তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের অনুষঙ্গ খাদ্য-পাণীয়ের কিছুই বাংলাদেশে সহজলভ্য নয়। বাংলাদেশে এক বোতল ভালোমানের হুইস্কির দামে ভারতে ৫ বোতল কিনতে পারবে, স্বাভাবিক পোশাকে ঘুরে বেড়াতে পারবে স্বাচ্ছন্দ্যে, স্থানীয়দের উৎসুক ও কদর্য দৃষ্টিভঙ্গিতে বিব্রত হতে হবে না, এই পরিবেশ এখানে আছে? বিভিন্ন দেশে চাকরি করা এই কর্মকর্তা বলেন, এখানে বিদেশি বায়ার, ইনভেস্টররা আসে, নানারকম ডিল হয়। আমি তাদের যথাযথভাবে এন্টারটেইন করতে পারিনা। তাদের নিয়ে আমার যেতে হয় অন্য কোথাও। এটা আমার ব্যবসার জন্য সুখকর বা লাভজনক নয়। পর্যটক টানতে হলে সবার আগে দরকার পরিবেশ এবং স্থানীয়দের মানসিকতা উন্নত করা। এটা ঠিক না হলে এই খাত থেকে মুনাফার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলাই উত্তম। পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে আস্থা গড়ে ওঠে না। প্রায়ই তাদের হয়রানির অভিযোগ পাওয়া যায়, যা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। ট্যুর অপারেটরদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় বিদেশি বুকিং এ বছর ৬০–৭০ শতাংশ কমেছে। কক্সবাজার, সুন্দরবন কিংবা সিলেটের মতো জায়গায় ইউরোপ-আমেরিকার অতিথিদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। এর প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ওপর। এক শীর্ষ ট্যুর অপারেটরের প্রধান নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমাদের ৮০ শতাংশ ব্যবসাই ছিল বিদেশি পর্যটক নির্ভর। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতার পর থেকে একের পর এক বুকিং বাতিল হচ্ছে। এখন অফিস খরচ চালানোই দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১০ জন কর্মীর মধ্যে ছয়জনকে ছাঁটাই করতে হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না।” প্যাসিফিক এশিয়া ট্র্যাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান বলেন, “রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। এর ওপর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়াসহ প্রায় ২০টি দেশ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে বিদেশি পর্যটক ৭০–৮০ শতাংশ কমে গেছে।” সমস্যা অনেক, সমাধান অজানা বিশ্লেষকদের মতে, একক কোনো কারণে নয়, বহু বছরের জমে থাকা সমস্যার বিস্ফোরণ ঘটছে এখন। সমন্বয়হীনতা: পর্যটন মন্ত্রণালয়, কর্পোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড ও স্বরাষ্ট্র–পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রকট। অন-অ্যারাইভাল ভিসা, ই-ভিসা চালু না হওয়া ও বিমানবন্দরে হয়রানি বিদেশিদের নিরুৎসাহিত করছে। অদক্ষতা ও পরিকল্পনার ঘাটতি: সংকট নিরসনে কার্যকর পরিকল্পনা নেই। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের গতি শ্লথ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সূচকে ১১৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১০তম। প্রচারণা ও ব্র্যান্ডিংয়ের দুর্বলতা: বিদেশে কার্যকর প্রচার নেই। ডিজিটাল মার্কেটিং ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংয়ে পিছিয়ে। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে: মালদ্বীপ ২০২৩ সালে পর্যটন থেকে ৪.৫ বিলিয়ন ডলার, নেপাল ৮০০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। বাংলাদেশে এ আয় ৩০০ মিলিয়নেরও নিচে। এমনকি সংকটময় শ্রীলঙ্কাও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পর্যটকদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান বলেন, “আমাদের ট্যুরিজম ডেটা সেন্টার এখনো হয়নি। ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্যে ২০২৪ সালে ৬ লাখ ২৫ হাজারের বেশি বিদেশি এসেছেন, তবে প্রকৃত পর্যটক এর চেয়ে কম হতে পারে।” পর্যটন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান সায়মা শাহীন সুলতানা জানান, “জিডিপিতে পর্যটনের অবদান মাত্র ৩ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। তবে শিগগিরই ‘২০২৪ ট্যুরিজম পলিসি’ অনুমোদন হবে।” ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, “পর্যটন মহাপরিকল্পনা না থাকায় অবকাঠামো অপরিকল্পিতভাবে বেড়েছে। তবে সুযোগ শেষ হয়নি। কক্সবাজারে পরিকল্পিতভাবে বিদেশিদের জন্য আবাসন গড়ে তোলা সম্ভব। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিতে বড় বিনিয়োগ আনা যায়।” ট্যুরিজম কর্পোরেশন বোর্ডের পরিচালক মহিউদ্দিন হেলাল বলেন, “কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে নেপাল, ভুটান, ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চল থেকেও পর্যটক আসতে পারবেন। এখানকার আকর্ষণগুলো এখনো কাঁচামাল পর্যায়ে আছে, এগুলোকে পর্যটনপণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।” ওয়ার্ল্ড ট্যুরিজম নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ গোলাম কাদেরের মতে, “আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পরিচালনার মতো প্রস্তুতি সরকারের নেই। টার্গেট মার্কেট নির্ধারণ ও তাদের জন্য সুবিধা নিশ্চিত না করলে কেবল অবকাঠামো দিয়েই পর্যটক টানা যাবে না।” টিজিএবি সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুল ইসলাম (বুলু) বলেন, “শুধু বিমানবন্দর নয়, কক্সবাজারকেই পর্যটকবান্ধব করে তুলতে হবে। বিদেশি পর্যটক আনার জন্য প্রচার-প্রচারণা ও রোড শো দরকার। বিদেশি ভাষাজানা গাইডেরও ঘাটতি রয়েছে।” উদ্যোক্তাদের মত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে এলেও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। তারা মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহার করে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে পদক্ষেপ নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. শাকের আহমেদ বলেন, “কেবল সমুদ্রসৈকতই যথেষ্ট নয়। বিদেশি পর্যটকদের জন্য নাইট লাইফ, জাদুঘর, শপিং মল, বার, ক্যাসিনো দরকার। পাহাড় ও ঐতিহ্য দেখানোর জন্যও উন্নত যানবাহন, গাইড ও সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন।” বেসরকারি উদ্যোক্তারা তারকা মানের হোটেল-রিসোর্ট নির্মাণ করেছেন। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা ও নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে তাঁরা আস্থা পাচ্ছেন না। ভারতের “ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া”, থাইল্যান্ডের “অ্যামেজিং থাইল্যান্ড”, মালয়েশিয়ার “ট্রুলি এশিয়া” বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়েছে। তুলনায় বাংলাদেশের “বিউটিফুল বাংলাদেশ” প্রচারণা প্রাণহীন। ওয়েবসাইটে তথ্যের ঘাটতি, ডিজিটাল প্রচারণার দুর্বলতা এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে অনুপস্থিতির কারণে এই ব্র্যান্ডিং প্রভাব ফেলতে পারেনি। আশাবাদ নীতিনির্ধারকদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বলেন, “আমরা একটি নীতিমালা প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। সারা দেশের পর্যটন কার্যক্রমের জন্য আচরণবিধি তৈরি করছি।” বিদেশি পর্যটক কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য এখন দেশি পর্যটকদের নিরাপদ ও আনন্দময় ভ্রমণ নিশ্চিত করা। সামগ্রিক উন্নতি হলে পর্যটনশিল্পও এগোবে।”