প্রকল্প বাস্তবায়নে সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাদের এলাকাপ্রীতিতে বঞ্চিত সমস্যাগ্রস্ত জেলার মানুষ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র (বৈছা) আন্দোলনের সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা ক্ষমতায় এসে নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে বিপুল অর্থের প্রকল্প নিচ্ছেন, যখন দেশের অনেক সমস্যাগ্রস্ত জেলার মানুষ মৌলিক অবকাঠামোর অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ও এনসিপির সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহর কুমিল্লার জন্য ২,৪০০ কোটি টাকার প্রকল্প এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদের সাতক্ষীরায় ২,১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়ে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এদিকে, কুড়িগ্রামের মতো গুরুতর সমস্যায় জর্জরিত জেলাগুলো উন্নয়নের বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কুমিল্লা ও সাতক্ষীরায় বিশাল বরাদ্দ, বঞ্চিত অন্যান্য জেলা তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) কুমিল্লায় ২,৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে, যার সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ (৪৫৩ কোটি টাকা) দেওয়া হচ্ছে আসিফ মাহমুদের উপজেলা মুরাদনগরে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বরাদ্দ (৩৩৮ কোটি টাকা) হাসনাত আবদুল্লাহর উপজেলা দেবীদ্বারে। একইভাবে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদের জেলা সাতক্ষীরায় এলজিইডি ২,১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে, যেখানে তিনি নিজেই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। পরিকল্পনা কমিশন জানায়, এলজিইডির ইতিহাসে কোনো জেলার জন্য এত বড় একক প্রকল্প অভূতপূর্ব। অথচ, কুড়িগ্রামের মতো জেলাগুলো, যেখানে ৭০ শতাংশ উপজেলা সড়ক খারাপ, তাদের জন্য কোনো একক প্রকল্প নেই। এলজিইডির কুড়িগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী ইউনুছ হোসেন বিশ্বাস বলেন, গত অর্থবছরে রাস্তাঘাট মেরামতে তাদের চাহিদা ছিল ৮০ কোটি টাকা, কিন্তু পেয়েছেন মাত্র ৪০ কোটি। তিনি আরও বলেন, “মানুষ রাস্তাঘাট মেরামতের দাবি নিয়ে আসেন, কিন্তু আমরা টাকার অভাবে কিছু করতে পারি না।” এই বৈষম্য দেশের উন্নয়ন নীতিতে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এলাকাপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ ও হাসনাত আবদুল্লাহ ও তার সঙ্গীরা সহিংসতার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটান। ক্ষমতায় এসে তাদের নিজ এলাকায় বিপুল বরাদ্দ নেওয়ার প্রবণতা জনমনে ‘দুর্নীতি’ ও ‘স্বজনপ্রীতি’র অভিযোগ তুলেছে। নেটিজেনরা বলছেন, এই প্রকল্পগুলো আসলে আগামী নির্বাচনের খরচের বন্দোবস্ত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হচ্ছে। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন, তারাই এখন উন্নয়নের নামে স্বজনপ্রীতি করছেন।” এই অভিযোগ শুধু কুমিল্লা বা সাতক্ষীরার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যান্য উপদেষ্টা ও সমন্বয়কদের মধ্যেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছে। বঞ্চিত জেলার দুর্ভোগ কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধার মতো জেলাগুলোতে রাস্তাঘাটের বেহাল দশা দীর্ঘদিনের সমস্যা। এলজিইডির তথ্যমতে, এই জেলাগুলোর বেশিরভাগ সড়ক ‘খারাপ’ বা ‘অত্যন্ত খারাপ’ শ্রেণিতে পড়ে। অথচ, এসব জেলার জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ বা একক প্রকল্প নেই। ফলে, স্থানীয় মানুষ দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি, এবং জরুরি সেবার অভাবে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। কুড়িগ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন, “আমাদের রাস্তা দিয়ে হাঁটাই কঠিন, অথচ ঢাকা থেকে শুনি কোটি কোটি টাকার প্রকল্প অন্য জেলায় যাচ্ছে।” দুর্নীতির ছায়া ও জনগণের ক্ষোভ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে।” স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “দুর্নীতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা, যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে।” কিন্তু ছাত্র সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাদের এলাকাপ্রীতি এই সমস্যাকে আরও গভীর করছে। জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, “যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, তারা কি এখন নিজেরাই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন?” দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনও এই অভিযোগের তদন্তের দাবি জানিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের আদর্শ রক্ষায় ছাত্র সমন্বয়ক ও উপদেষ্টাদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ পদক্ষেপ নেওয়ার সময় এসেছে, নতুবা জনগণের আস্থা হারানোর ঝুঁকি বাড়বে।