ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৫% হারে বৈদেশিক ঋণ: সরকারের নতুন ‘অর্থনৈতিক ঝুঁকি’ নিয়ে উদ্বেগ

বাংলাদেশ সরকার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে মোট ৭৫৩ মিলিয়ন ডলারের ঋণ নেওয়ার অনুমোদন পেয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ সুদের হার—প্রায় ৫%—এ হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে। এই ঋণগুলোর শর্তাবলী এতটাই কঠিন যে অর্থনীতিবিদরা এটিকে ‘অর্থনৈতিক ঝুঁকির নতুন মাত্রা’ বলে অভিহিত করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের বৈদেশিক ঋণ নীতির সমালোচনার প্রেক্ষাপটে ইউনূস সরকারের এমন সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদী চাপ বাড়াবে বলে জনমনে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) স্ট্যান্ডিং কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে এই ঋণগুলোর অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ‘নেটওয়ার্ক নর্থওয়েস্ট ডিস্ট্রিবিউশন মডার্নাইজেশন প্রজেক্ট’-এ ৯১ মিলিয়ন ডলার, ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েল গেজ রেলপথে রূপান্তর প্রকল্প’-এ ৫০৮ মিলিয়ন ডলার এবং ‘খুলনা ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট (ফেজ-২)’-এ ১৫৪ মিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্পগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ নেটওয়ার্কের আধুনিকীকরণ, রেল যোগাযোগের উন্নয়ন এবং খুলনায় নির্ভরযোগ্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে। ঋণের মেয়াদ ২৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর নির্ধারিত হয়েছে। সুদের হার নির্ধারিত হয়েছে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট (এসওএফআর) + লেন্ডিং স্প্রেড + ম্যাচুরিটি প্রিমিয়াম হিসেবে। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে এসওএফআর হার ৪.৩৯% ছিল, যা যোগ করলে স্প্রেড (০.৫০%) এবং প্রিমিয়াম (০.১০%) সহ সামগ্রিক সুদের হার প্রায় ৫% হয়ে যায়। এছাড়া ০.১৫% কমিটমেন্ট ফি আলাদাভাবে দিতে হবে। এই হারে ঋণ নেওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব, যা পূর্ববর্তী সরকারগুলোর যেকোনো ঋণের চেয়ে উচ্চ। অর্থনীতিবিদ এবং বিশ্লেষকরা এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করছেন। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, “এত উচ্চ সুদের হারে ঋণ নেওয়া দেশের অর্থনীতির উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে। বিগত সরকারের সময় থেকে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বেড়েছে—২০১৪ সালে ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৪ সালে ৯৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে—এবং এখন সুদের হারও সর্বোচ্চ। এটি শুধুমাত্র অবকাঠামো নয়, ভবিষ্যতের জেনারেশনের উপর বোঝা চাপাবে।” তিনি আরও যোগ করেন, “পূর্ববর্তী সরকারকে অর্থনীতি ধ্বংসের অভিযোগ করা হয়েছে, কিন্তু এখন এই হারে ঋণ নেওয়া দেখিয়ে দিচ্ছে যে সমস্যাটি চলমান।” বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বৈদেশিক ঋণের সর্বোচ্চ পরিশোধ ৩.২১ বিলিয়ন ডলার হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ২৫% বেশি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দশকের মধ্যে ১২৫% বেড়েছে, এবং সুদের পরিশোধ ৪৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে নতুন ঋণগুলোর সুদের চাপ দেশের বাজেটের ২.৬% পর্যন্ত দখল করে নেবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, এই ঋণগুলো অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন উঠছে—যখন অর্থনীতি ডলার সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির মুখে রয়েছে, তখন কি এত উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া ‘আরামের’ সিদ্ধান্ত? অর্থনীতিবিদরা দাবি করছেন, সরকারকে এখনই ঋণ নীতি পুনর্বিবেচনা করে কনসেশনাল (সহায়ক) ঋণের দিকে ঝুঁকতে হবে, নয়তো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে।