নিজ ভূখণ্ডে পাকি বিমানবাহিনীর বোমাবর্ষণ: নারী-শিশুসহ নিহত ৩০, অস্বীকার সরকারের

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখুয়া প্রদেশের তিরাহ উপত্যকায় সামরিক বিমান হামলায় নারী ও শিশুসহ অন্তত ৩০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। গতকাল রোববার দিবাগত রাত ২টার দিকে এই হামলা চালানো হয়, যাতে ৮টি বোমা ফেলা হয় বলে দাবি করা হয়েছে। পিটিআইয়ের খাইবার পাখতুনখুয়া শাখা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (পূর্বে টুইটার) ছবি-ভিডিওসহ ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করে সরকারকে অভিযুক্ত করেছে। তবে, পাকিস্তান সরকার এখনও এই অভিযোগের অস্বীকার করে বলছে যে, এটি তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি) সন্ত্রাসীদের বোমা তৈরির উপকরণের বিস্ফোরণের ফলাফল। মাতরে দারা গ্রামে ধ্বংসযজ্ঞ হামলাটি খাইবার পাখতুনখুয়ার তিরাহ উপত্যকার মাতরে দারা (মাত্রে দারা) গ্রামে সংঘটিত হয়েছে, যা আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চল এবং টিটিপির কার্যক্রমের জন্য পরিচিত। পিটিআইয়ের দাবি অনুসারে, পাকিস্তান বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান (জেএফ-১৭ থেকে এলএস-৬ বোমা) রাত ২টার দিকে ৮টি বোমা ফেলে, যাতে স্থানীয় পাঁচটি বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয় সূত্রের হিসাবে, ধ্বংসস্তূপ থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশ নারী ও শিশু। পরবর্তী রিপোর্টে মৃতের সংখ্যা ৩০-এ উন্নীত হয়েছে, এবং আহতের সংখ্যা আরও বেশি। পিটিআইয়ের খাইবার পাখতুনখুয়া শাখা এক্সে পোস্ট করে বলেছে, “খাইবার প্রদেশের তিরাহ উপত্যকায় হামলায় স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর বেশ কিছু বোমা পড়েছে। স্থানীয় নাগরিকদের পাঁচটি বাড়ি ধ্বংস হয়েছে। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, ধ্বংসস্তূপ থেকে এ পর্যন্ত ২০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে শিশু ও নারী রয়েছে। এই দুঃখ ও কষ্ট প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা আমাদের নেই। কখনো ড্রোন, আবার কখনো বোমা হামলা—এত বেশি ঘৃণার বীজ বপন করেছে যে, যখন এই লাভা বিস্ফোরিত হবে, তখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।” পিটিআই নেতা ইকবাল আফ্রিদি এক্সে পোস্ট করে বলেন, “তিরাহ আকাখেলে আমাদের নিজস্ব রক্ষকরা নির্দয়ভাবে নিরপরাধ শিশু, যুবক ও নারীদের শহীদ করেছে। এটি মানবতার বিরুদ্ধে খোলা অপরাধ। বিশ্ববাসী, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে অনুরোধ: গাজা-প্যালেস্টাইনের মতো আমাদের জন্যও কণ্ঠস্বর তোলুন।” পিটিআই আইনসভা সদস্য আবদুল গানি ঘটনাকে “বিপর্যয়কর” বলে অভিহিত করেছেন। সরকারের অস্বীকার: ‘সন্ত্রাসীদের বিস্ফোরণ’ পাকিস্তান সরকার বা সামরিক বাহিনী এখনও ঘটনার অফিসিয়াল বিবৃতি দেয়নি। তবে, স্থানীয় পুলিশ ও অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্ট অনুসারে, এটি বিমান হামলা নয় বরং টিটিপি সন্ত্রাসীদের বোমা তৈরির উপকরণের দুর্ঘটনাজনিত বিস্ফোরণ। পুলিশ বলছে, ২৪ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে সন্ত্রাসীও রয়েছে। তিরাহ উপত্যকা টিটিপির লুকানো ঘাঁটির জন্য পরিচিত, এবং সামরিক বাহিনী সেখানে প্রায়ই অভিযান চালায়। সরকারের দাবি, সন্ত্রাসীরা বেসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন (এইচআরসিপি) ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছে, “তিরাহ উপত্যকায় বিমান হামলায় শিশুসহ বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুতে আমরা হতবাক। কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে নিরপেক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিতে হবে।” এইচআরসিপি বলছে, খাইবার পাখতুনখুয়ায় ড্রোন ও বিমান হামলায় বেসামরিক মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ। সন্ত্রাসবাদের ছায়ায় অস্থিরতা খাইবার পাখতুনখুয়া, বিশেষ করে তিরাহ উপত্যকা, আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকা হিসেবে টিটিপি ও অন্যান্য চরমপন্থী গোষ্ঠীর কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। ২০২৪ সালে এই প্রদেশে ৬০৫টি সন্ত্রাস-সংশ্লিষ্ট ঘটনা ঘটেছে, যাতে শত শত নিহত হয়েছে। ২০১৪ সালের সামরিক অভিযানের পর টিটিপি কাবুলের তালেবানের সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে কার্যক্রম পুনরায় শুরু করেছে। সাম্প্রতিককালে জায়শ-ই-মোহাম্মদ (জেএম) ও হিজবুল মুজাহিদিনের মতো গোষ্ঠীও এখানে ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পিটিআই, যা বর্তমানে নিষিদ্ধ এবং নেতা ইমরান খান কারারুদ্ধ, এই ঘটনাকে সরকারের “রাষ্ট্রীয় অত্যাচার” বলে অভিহিত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের হামলা স্থানীয় জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়িয়ে সন্ত্রাসবাদকে উস্কে দিতে পারে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো ঘটনার স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে। ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ চলছে, এবং স্থানীয় প্রশাসন নিরাপত্তা বাড়িয়েছে। এই ঘটনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতাকে নতুন করে তুলে ধরেছে।