বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র, সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা

সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা, প্রকারান্তরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র। বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাঙ্গালীর জাতিসত্ত্বা, জাতীয় সঙ্গীত এবং বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সংবিধান, স্বাধীনতার মূল্যবোধ, সবই আজ হুমকির মুখে পতিত হয়েছে। এ মুহূর্তে রাষ্ট্র পরিচালনায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ব্যক্তিবর্গ খুব জোরে সোরেই মহান মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে কাজ করছে, সেটি আর রাখঢাকের কোনো সুযোগ নাই। সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র অর্থাৎ বর্তমান সংবিধান বাতিল করা, নতুন করে সংবিধান প্রণয়ন করা, সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদকে তোয়াক্কা না করে মৌলিক অধিকারের সহিত অসমঞ্জস আইন প্রণয়ন করা, সংস্কারের নামে সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করা, সংবিধান স্থগিত রাখা, এসব আলোচনা এবং কার্যক্রমই ইউনুস সাহেব ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই শুরু হয়েছে। অথচ ইউনুস সাহেব বর্তমান সংবিধানকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট শপথ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি ও বাস্তবায়ন নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে প্রশ্ন আসছে, সাংবিধানিক আদেশ জারির মাধ্যমে সংশোধনীগুলোকে এখনই কার্যকর করা যায় কি-না? সংলাপে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জনগণের অভিপ্রায়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের আদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে। জামায়াতের দাবি, নির্বাচনের আগেই প্রভিন্সিয়াল সাংবিধানিক আদেশে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। ইসলামী আন্দোলন সহ ১১টি দলের একই অবস্থান। জামায়াতে ইসলামীর নেতা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বিতর্কটা আগেই শুরু করেছেন। তিনি ১৮ জুলাই, ২০২৫ তাঁর ফেসবুক পেজে প্রধান উপদেষ্টার উদ্দেশে একটি সরাসরি বার্তা দিয়েছেন। সেখানে তিনি গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে সাহসী ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, আপনি পিছনে ফিরে তাকাবেন না। গণঅভ্যুত্থানই আপনার সবচেয়ে বড় মেন্ডেট। জুলাই ঘোষণা-জুলাই সনদ দিয়ে দিন। সংবিধান স্থগিত করুন। নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচন দিন। কাজ শেষ।’ অর্থাৎ বর্তমান সংবিধান স্থগিত হয়ে যাবে, জুলাই সনদই হবে সংবিধান এবং তারই আলোকে নির্বাচন। পরে অবশ্য তিনি ‘প্রধান উপদেষ্টা’ সম্বোধনটা সরিয়ে নেন। এই নেতা এখন প্রশ্ন তুলেছেন, সংবিধানের কোন আইনে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে! তিনি বলছেন, জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি ছাড়া দেশ গভীর সংকটে পড়বে। জুলাই সনদের আইনী ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে জামায়াত সহ সমমনা ইসলামী দলগুলো ইতোমধ্যে রাজপথে কর্মসূচি দিয়েছে। অপরদিকে বিএনপির অবস্থান বিপরীত। বিএনপির পক্ষে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের মতামতে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সাংবিধানিক সরকার। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সংবিধানের কোনো অংশ স্থগিত বা বাতিল হয়নি। তাই আদেশ জারির মাধ্যমে দ্বৈত সংবিধানের পথে যাওয়া যাবে না, সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধনের সুযোগ নাই। তাঁর বক্তব্য, প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহের আলোকে আগামী সংসদের প্রথম দুই বছরে সংবিধান সংস্কার করা হবে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য এবং দেশের বিদ্যমান সহিংস পরিস্থিতির কারণে ইউনুস সাহেব যদি বিদেশ সফরে গিয়ে আর না ফেরেন, দায়িত্ব ছেড়ে দেন, তাহলে কী কী আইনী জটিলতা বা সংকট হতে পারে? সাংবিধানিক কী কী জটিলতা হতে পারে? আমি বলবো, কোনো জটিলতাই হবে না, সাংবিধানিক কোনো সংকটই হবে না। বরং সকল সংকটের অবসানের পথ উন্মোচিত হবে। ইউনুস সাহেব দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করলে, বর্তমানে ইউনুস সাহেবের সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে যে সকল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে বা যে সকল ত্রুটি রয়েছে, তা সংশোধনের সুযোগ তৈরি হবে। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদের আলোকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্স পাঠিয়ে যে মতামত নেয়ার আলোকে বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা নিয়েই তিমধ্যে অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যথাযথ ভাবে রেফারেন্সটি সুপ্রিম কোর্টে উপস্থাপন হয়নি, মতামতটি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিগণ কর্তৃক প্রণীত মর্মে সন্দেহ এবং অসম্পূর্ণ। কারণ, মতামতে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন, এর কার্যক্রম ও কার্যকাল নিয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলা নাই। অবশ্য তখন রেফারেন্সটির যথাযথ নিষ্পত্তির সুযোগ দেশে বিদ্যমান ছিল না। আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল, বিচারপতিরা পলাতক ছিলেন, প্রধান বিচারপতি সহ একাধিক বিচারপতি সেন আশ্রয়ে ছিলেন। এ মুহূর্তে ইউনুস সাহেব দায়িত্ব পালনে অপারগ হয়ে চলে গেলে, শান্ত পরিবেশে ঠান্ডা মাথায় সংকটের জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি সুনিপুণ ভাবে লিপিবদ্ধ করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পাঠানো যাবে, আদালতের কার্যতালিকায় যথাযথ নিয়মে উত্থাপিত হয়ে শুনানীর মাধ্যমে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বীয় মতামত প্রদান সম্ভব হবে। অন্তর্বর্তী সরকারে থাকার যোগ্যতা, এর কাঠামো, কার্যক্রম এবং মেয়াদকাল নির্ধারণ করে দেয়া যাবে। যা অতীব জরুরি ছিল। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকার বা অনির্বাচিত সরকার কখনোই অনির্দিষ্টকালের জন্য গঠিত হতে পারে না। তাছাড়া রাম-সাম, যদু-কদু, যে কেউ সরকারের উপদেষ্টা বা মন্ত্রী হতে পারে না। এটির যোগ্যতা নিরূপণ অবশ্যই জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অবশ্যই সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য হতে হবে। আলোচনাটি আরো গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করি। বর্তমান বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে কোনো অনির্বাচিত সরকারের অস্তিত্ব নাই, কোনো অনির্বাচিত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ক্ষমতা দখলের কোনো সুযোগ নাই। তবুও সংকট যেহেতু তৈরি হয়েছে, সেহেতু সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদই একমাত্র রক্ষাকবচ। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ারের কথা বলা আছে। সেখানে কি বলা আছে? “যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে, আইনের এই রূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হইয়াছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যাহা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্ব সম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহা হইলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের মতামতের জন্য প্রেরণ করিতে পারিবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানীর পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করিতে পারিবেন।” আমার দৃষ্টিতে, ইউনুস সরকারের শপথ পড়ানোর পূর্বে জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে আপিল বিভাগে মতামতের জন্য পাঠানো রাষ্ট্রপতির প্রশ্নটিই অসম্পূর্ণ ছিল। যদি তর্কের খাতিরে ‘প্রশ্নটি অসম্পূর্ণ ছিল’ কথাটিই গনোর করি, তাতেও একটি বৃহৎ অনিয়ম সামনে আসে, তাহলো, আপিল বিভাগ উপযুক্ত শুনানীর পর মতামত দিবেন। এখানে উপযুক্ত শুনানী তো দূরের কথা, কোনো শুনানীই অনুষ্ঠিত হয়নি। অতএব বর্তমান সরকারের অবস্থানগত আইনী জটিলতা স্পষ্ট। এ অবস্থায় ইউনুস সাহেব যদি দয়াপরবশে অপারগতা প্রকাশ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ করে আপিল বিভাগে প্রেরণ করতে পারবেন এবং আপিল বিভাগ উপযুক্ত শুনানীর পর তাদের স্বীয় মতামত দিতে পারবেন। এছাড়া বর্তমান সংকট ও আশু সংকট থেকে উত্তরণের অতীব সুন্দর সমাধান হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে উচ্চ আদালতের মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পূর্ণ বহাল করে আগামী নির্বাচন সম্পন্ন করা, তাতে সকল বিতর্কের অবসান ঘটানো সম্ভব। এর বাইরে পথ হাঁটলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। জামায়াত সহ যারা এর বাইরে চিন্তা করছেন, তারা মূলতঃ সংকট সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের সকল নাগরিককে দেশের স্বাধীনতার সুমহান মর্যাদা রক্ষা ও বহু প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধান সুরক্ষায় সচেতন হওয়া উচিত। গোলাম হোসেন, আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী। সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫।