রাজশাহীতে খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল মজুদ, কোটি টাকার ধান্দায় যুক্ত সরকারি কর্মকর্তারা

২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৫:৪৮ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাজশাহীর সরকারি খাদ্যগুদামে নিম্নমানের ও খাওয়ার অনুপযোগী চাল ঢুকিয়ে পরে তা পাল্টে দেওয়ার প্রমাণ মিলেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ যোগসাজশে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ কাজ করে আসছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। জেলার বাগমারা উপজেলার ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে গিয়ে সরেজমিনে এমন অনিয়ম ধরা পড়ে। গত শনিবার সকালে সেখানে হাতেনাতে ধরা হয় চাল পাল্টানোর ঘটনা। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে চুক্তিবদ্ধ মিলারদের মাধ্যমে চাল সরবরাহের কথা। কিন্তু অভিযোগ আছে—ধান কেনার প্রক্রিয়া এড়িয়ে সরাসরি নিম্নমানের চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। এতে ধান ছাঁটাই, পরিবহন ব্যয়সহ ভালো মানের চালের খরচ দেখিয়ে কোটি টাকার অপব্যবহার হয়েছে। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয় করেই স্থানীয় কর্মকর্তারা এ অনিয়মের সুযোগ নিয়েছেন। ৪ঠা সেপ্টেম্বর বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল ইসলাম ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে হঠাৎ অভিযান চালান। সেখানে বিপুল পরিমাণ নষ্ট ও খাওয়ার অনুপযোগী চাল পাওয়া গেলে তিনটি গুদাম সিলগালা করা হয়। পরবর্তীতে ওই গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বাচ্চু মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর আগে ২৬শে আগস্ট দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিনও স্থানীয় খাদ্যগুদামে অভিযান চালিয়ে একই ধরনের অনুপযোগী চাল জব্দ করেছিলেন। সেখান থেকে ১েই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৮০ মেট্রিক টন চাল সরানো হয়। দুর্গাপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, “ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদাম থেকে ২০০ মেট্রিক টন চাল দুর্গাপুরে আনা হয়েছিল। কিন্তু চালের মান খারাপ হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।” তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোরো মৌসুমে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে ৯ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ২ হাজার ৭২৩ মেট্রিক টন ধান কেনা হয়। জেলার বিভিন্ন মিলারের সঙ্গে চুক্তি করে চাল সংগ্রহের কথা ছিল। এর মধ্যে বাগমারার কনক চালকল, আরাফাত চালকল, ভাই ভাই চালকল, তানোরের আবদুস সাত্তার চালকল, হড়গ্রামের বাদশা রাইস মিল, মোহনপুরের নুরজাহান চালকল, মাহফুজ চালকল ও মোল্লা চালকলের নাম তালিকাভুক্ত ছিল। এ আটটি চালকল থেকে ১ হাজার ২১১ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ দেখানো হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোনো চালকল নিম্নমানের চাল দিলে তা কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কথা। একই সঙ্গে তাদের লাইসেন্স বাতিল ও সরবরাহকৃত চাল ফেরত নেওয়ারও বিধান রয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আরেকটি রহস্য। মোহনপুর উপজেলার লালইস গ্রামের মেসার্স মাহফুজুর রহমান চালকলের নামে দেখানো হয় ৪৮০ মেট্রিক টন ধান ভাঙিয়ে ৩১২ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ। কিন্তু স্বত্বাধিকারী মাহফুজুর রহমান দাবি করেন, তিনি কোনো চাল দেননি— এমনকি ধানও নেননি। তার ভাষায়, “আমার বাবা মিল চালাতেন। সম্প্রতি তিনি মারা যাওয়ার পর আমি একেবারেই দিশেহারা হয়ে আছি। এ গুদামে কোনো ধান বা চাল সরবরাহ করিনি।” একইভাবে, মোহনপুরের কামারপাড়ার মেসার্স নূরজাহান চালকলের নামে ১৮০ মেট্রিক টন ধান ভাঙিয়ে ১১৭ মেট্রিক টন চাল দেওয়ার হিসাব পাওয়া যায়। কিন্তু মালিক ওবায়দুল ইসলামও স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে কোনো ধান বা চাল সরবরাহ করিনি।” এদিকে হাতুড়িয়া গ্রামের মোল্লা চালকল ঘুরে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজকর্মই চলছে না। এক কর্মচারী জানান, এ বছর বৃষ্টির কারণে মিল বন্ধ রয়েছে। পরে মুঠোফোনে মালিক হারেচ আলী মোল্লা দাবি করেন, তিনি ভবানীগঞ্জ গুদামে চাল দিয়েছেন। তবে কত টন দিয়েছেন—সেই তথ্য তিনি জানাতে পারেননি। ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল সরবরাহের পেছনে আরেকটি চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। স্থানীয় চালকলমালিকদের একটি সূত্র জানায়, মোহনপুর উপজেলার আতাউর রহমান নামের এক ব্যবসায়ী নিজস্ব লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও অন্য মিলের নামে চাল সরবরাহ করে আসছেন। খাদ্যগুদামের সঙ্গে যোগসাজশেই তিনি এ কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন। গত শুক্রবার সকালে যোগাযোগ করা হলে আতাউর রহমান স্বীকার করেন, তার নামে কোনো লাইসেন্স নেই। তবে অন্য ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স ব্যবহার করে তিনি ৪২০ মেট্রিক টন ধান নিয়ে চাল উৎপাদন করেছেন। এ অভিযোগে জবাব দিতে গিয়ে তিনি দাবি করেন—তার দেওয়া চাল ভালো মানের ছিল। বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমস্যায় পড়েছেন কিছু “লাল চাল” নিয়ে, যা সরকারি চাল নয়। তার ভাষায়, “আমি শুধু সহযোগিতা করেছি। মোটে ১৫ টন ৩০০ কেজি চাল দিয়েছি।” কিন্তু খাদ্যগুদাম সূত্র বলছে ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, রাতের আঁধারে গোপনে চাল আনা হচ্ছে। গত শনিবার সকালে সরেজমিনে ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে গিয়ে দেখা যায়, একটি ট্রাক চাল নিয়ে প্রবেশ করছে। ট্রাকচালকের হাতে থাকা হিসাবপত্রে মালিক হিসেবে লেখা আতাউর রহমানের নাম। জিজ্ঞাসাবাদে চালক স্বীকার করেন, তিনি নওগাঁ থেকে চাল নিয়ে এসেছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মিলারের সিলমোহরসহ চালানপত্র থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ওই ট্রাকে আসা বস্তাগুলোতে কোনো সিল ছিল না। এমনকি অনেক বস্তা আকারেও ছোট। এ সময় বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গুদামের ভেতরে বসে ছিলেন। অনিয়ম নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি এখন ভারমুক্ত। এসব বিষয়ে আর কিছু বলার নেই।” তবে চাল আনতে যে খরচ হচ্ছে, তা কে বহন করছে জানতে চাইলে তিনি যোগ করেন, “আমি কিছু দিচ্ছি, মিলারও দিচ্ছেন।” এ অনিয়ম নিয়ে বাগমারার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুল ইসলাম বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই বড় প্রতিবেদন দিয়েছি। এরপর থেকে আর সেখানে যাওয়া হয়নি।” রাজশাহী জেলা খাদ্য কর্মকর্তা (ডিসি ফুড) ওমর ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। পরে দুপুরে ফের যোগাযোগ করলে বলেন, “একটি তদন্ত কমিটি সেখানে কাজ করছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়।” এরই মধ্যে দুর্গাপুর ও ভবানীগঞ্জ খাদ্যগুদামে খাওয়ার অনুপযোগী চাল ধরা পড়ার ঘটনায় জেলার সব খাদ্যগুদামে তদন্ত শুরু হয়েছে। আটটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ভবানীগঞ্জ ও দুর্গাপুর খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সাময়িক বরখাস্তও করা হয়েছে।