প্রকল্পে অপচয়ের উৎসব

রাজধানীর আজিমপুরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন আবাসন প্রকল্প হাতে নিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর, যা বাস্তবায়নে প্রথমে ৮৫৪ কোটি টাকার প্রস্তাব থাকলেও ব্যয়ের নানা খাত নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রায় ৮০ কোটি টাকা কমিয়ে ৭৭৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৯.৬৬ একর জমিতে পুরোনো ভবন ভেঙে ২০ তলার ১১টি বহুতল ভবনে ৮৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ হবে। তবে প্রস্তাবনায় কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, গাড়ি, আসবাব, কমিটির সদস্য সম্মানী, এমনকি শিশুদের খেলার মাঠ ও পানি সংরক্ষণাগারের জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল, যা অপচয় ও অস্বচ্ছ ব্যয়ের উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কিছু খাত থেকে ব্যয় সংকোচন করা হলেও প্রকল্পে এখনো কোটি কোটি টাকার অতিরিক্ত ব্যয় নির্ধারণের অভিযোগ রয়ে গেছে। নথিপত্র বলছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসনের প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ শেষ করে জোন-সি তে মনোযোগ দিয়েছে গণপূর্ত অধিদপ্তর। ৮৫৪ কোটি টাকার প্রস্তাব দিলেও এই প্রকল্পে লিফট, ভূমি উন্নয়ন, আরবরিকালচার ও ল্যান্ডস্কেপিং, শিশুদের খেলার মাঠ, বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট, মাটি পরীক্ষা, ডিজিটাল সার্ভে, ম্যাটেরিয়াল ট্রিটমেন্ট, আর্কিটেকচারাল ও থ্রিডি মডেল নকশা, বৈদ্যুতিক নকশা, কাঠামোগত নকশা, বিজ্ঞাপন, টেন্ডার, স্টেশনারি স্ট্যাম্প,সদস্যদের সম্মানী, ইউটিলিটি চার্জ, ডিপিডি বা ডেসকো কানেকশন চার্জ এবং আপ্যায়ন ব্যয় হ্রাস করতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্প থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা কমিয়ে গত আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ৭৭৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১০ সদস্যের একটি টিমের সাত দিনের বিদেশ সফরের প্রস্তাব বাতিল করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ব্যয় হবে প্রায় ১৩১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। ২০২৬-২৭ অর্থবছরে প্রায় ৩৫৬ কোটি ৫৫ লাখ এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ২৮৬ কোটি ১৪ লাখ ব্যয় করা হবে। ৯.৬৬ একর জমিতে ৩২টি পুরোনো ভবন ভেঙে ২০ তলার ১১টি বহুতল ভবনে কর্মচারীদের জন্য ৮৩৬টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের পাশেই (জোন-ডি) ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্মকর্তাদের জন্য আরও একটি প্রকল্পের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্প জোন এ, বি, সি, ডি হিসেবে উল্লেখ করা হলেও খুব কাছাকাছি একই জায়গায় এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও আলাদা নন। নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক (পিডি) একজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত। জোন এ, বি, সি, ডি বলা হলেও প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা আলাদা না হলেও প্রতিটি প্রকল্পে অফিস ও অফিসের আসবাব, বেতন-ভাতা, যাতায়াতের জন্য গাড়ি (ক্রয় বা ভাড়া) ও মোটরসাইকেলের কথা উল্লেখ থাকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বেতন এবং অফিস ও অফিসের আসবাবসহ সবকিছু মিলিয়ে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। অভিযোগ রয়েছে, অফিস ও আসবাব না কিনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বরাদ্দের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নেন। কর্মকর্তারা পদাধিকার বলে যে সরকারি গাড়ি পান, তা দিয়েই প্রকল্পের সাইট ভিজিট করেন; আবার মোটরসাইকেল কেনার কথা বলা হলেও তা কেনা হয় না, আগের প্রকল্পের বা নিজস্ব গাড়ি অথবা মোটরসাইকেল ব্যবহার করে সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করেন। এ কারণে প্রকল্পে গাড়ি ও আসবাবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহারের কথা বলা হলেও প্রকল্প শেষে সেগুলো জমা দিতে পারেন না কর্মকর্তারা। প্রস্তাবিত ডিপিপিতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় সিদ্ধান্তে প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করা হয়। পিইসি সভার সুপারিশের ভিত্তিতে ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ১০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ২০ তলা ভবন ৬টি, ৬৫৭৭৪.৫ বর্গ মি.-এর ব্যয় ৩১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা; ৮০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ২০ তলা ভবন ৫টি, ৪৫১৯৬.৮৫ বর্গ মি.- এর ব্যয় ২১০ কোটি ৯৮ লাখ; ৯০০০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ১টি ৬ তলা সার্ভিস ভবন ৬০২০.০৬ বর্গ মি.- এর ব্যয় ৩০ কোটি ২২ লাখ; ১৫০০০ বর্গফুটের একটি ৬তলা মাল্টিপারপাস ভবন ৩৮০২.৫২ বর্গ মি.-এর ব্যয় ৩৮ কোটি এবং ৬০০০ বর্গফুটের একটি ৬তলা মসজিদ ভবন ১২৮২.০৪ বর্গ মি.-এর ব্যয় ১০ কোটি ৫ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ওয়াকওয়ে এবং পার্কিং ১৯৪০১.৮৮ বর্গমিটার, ৬ কোটি ১৬ লাখ; আরসিসি মাস্টার ড্রেন ৯০০০ মিটার, ৫ কোটি ৫ লাখ; স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ২টি, ৮ কোটি; ভূগর্ভস্থ জলাধার (অগ্নি নির্বাপক) ৫৫০০০০ গ্যালন, ৫ কোটি ৯ লাখ; স্যুয়ারেজ ও অন্যান্য ময়লা পানির ড্রেন, পরিদর্শন পিট, পিটের ঢাকনা, স্যুয়ারেজ লাইন ১টি, ১০ কোটি ২৯ লাখ; সাব-স্টেশন ১৪ সেট, ১৬ কোটি ৬৫ লাখ; ইমার্জেন্সি জেনারেটর এটিএস ও ক্যানোপিসহ ১৪ সেট, ৫ কোটি ৫৬ লাখ; লিফট ৩৭টি, ৩২ কোটি ২৭ লাখ; ১১ কেভি এক্সপ্রেস লাইনের কাজ ১টি, ৫ কোটি ৯৪ লাখ এবং একটি ফায়ার প্রটেকশন ও ডিটেকশন সিস্টেমের জন্য ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত ডিপিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৫ হাজার বর্গফুটের ডাবল বেজমেন্টের ৬ তলা মাল্টিপারপাস ভবন, ৩৮০২.৫২ বর্গমিটার ৩৮ কোটি ৫২ লাখ; ফোর্স ভেন্টিলেশন সিস্টেম ও স্টেয়ারকেস ১টি, আড়াই কোটি; মসজিদে সাউন্ড সিস্টেম প্রায় ৪২ লাখ; মসজিদ ও মাল্টিপারপাস ভবনের জন্য ১২৬ টন এসি, ১ কোটি ৬৪ লাখ; সোলার সিস্টেম ১৫৫ কিলোওয়াট, ২ কোটি ১৯ লাখ; পিডি অফিসের আসবাবপত্র ৭ লাখ; আরবরিকালচার ও ল্যান্ডস্কেপিং ১ কোটি ২০ লাখ; ভূমি উন্নয়ন ২২৮৪৩ ঘনমিটার ১ কোটি ৭৩ লাখ; ৫ জন কর্মকর্তার বেতন-ভাতা ২ কোটি ১৭ লাখ; ৩ জন আউটসোর্সিং কর্মীর জন্য ২২ লাখ; কমিটির সদস্যদের সম্মানী ৩০ লাখ; আপ্যায়ন খরচ ১০ লাখ; মাটি পরীক্ষার খরচ প্রায় ৪১ লাখ; ডিজিটাল সার্ভে খরচ দেড় কোটি; আর্কিটেকচারাল নকশা, থ্রিডি মডেল, প্লাম্বিং ও কাঠামো নকশা ৩৯ লাখ; বৈদ্যুতিক নকশা (ফায়ার প্রটেকশন ও ডিটেকশন লে-আউট) ১২ লাখ; বিজ্ঞাপন ও টেন্ডার ডকুমেন্টস ৩০ লাখ; স্টেশনারি সিল-স্ট্যাম্প ১৫ লাখ; পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ১০ লাখ; যানবাহন ভাড়া ২৬ লাখ; পুরোনো ভবন অপসারণ ৫ লাখ; ডিপিডিসি বা ডেসকো কানেকশন চার্জ ১ কোটি ৯ লাখ; অনাপত্তি ব্যয় ৫ লাখ; ওয়াসা চার্জ ১ কোটি ৪০ লাখ; তিন বছর অফিস ভাড়া ২২ লাখ; ইউটিলিটি চার্জ ১০ লাখ; বাউন্ডারি ওয়াল ও গেট ১০০৪.৩৬ মিটার ২ কোটি; প্রতি মিটারে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ওয়াকওয়ে ১৯৪০১.৮৮ বর্গমিটার, ৬ কোটি ১৬ লাখ; জলাশয় রিটেইনিং ওয়ালসহ ঘাটলা ও জগিং ট্র্যাক ৩ হাজার ঘনমিটার ৩ কোটি ৩৬ লাখ; বাচ্চাদের খেলার মাঠ ১৬৯৯০ ঘনমিটার ২ কোটি ২০ লাখ; ১৫০ মিটার গভীর ২টি ডিপ টিউবওয়েল, ২ কোটি ৪০ লাখ; সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ২টি, ৮ কোটি এবং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণাগার ১৫ গ্যালন, ১ কোটি ৩৭ লাখ ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত ডিপিপিতে ৫৮টি সেফটি ট্যাংকের জন্য ৬ কোটি ৭২ লাখ ব্যয় ধরা হলেও একনেক সভায় তা কমিয়ে ১ কোটি ৩৫ লাখ করা হয়েছে। অন্যদিকে একটি ডিস্ট্রিবিউশন লাইন ওয়াটার পাম্পের জন্য ৩৬ লাখ টাকা কমিয়ে প্রায় ৪ কোটি টাকা করা হয়েছে। ভূগর্ভস্থ জলাধার (অগ্নি নির্বাপক) ৫৫০০০০ গ্যালন, ৫ কোটি ৯ লাখ, এই কাজে ১৫ লাখ টাকা কমানো হয়েছে। সুয়েজ ও অন্যান্য ময়লা পানির ড্রেন পরিদর্শন পিট ও ঢাকনা লাইন, ১টির কাজ, ১০ কোটি ২৯ লাখ; সাব-স্টেশন (১০০০ একটি, ৮০০ সাতটি, ৫০০ পাঁচটি, ২০০ একটি কেভিএ আরএমইউ ট্রান্সফরমার, এইচটি এলটি, পিএফআই ও অন্যান্য ১৪ সেট, ১৯ কোটি ৫৮ লাখ); ইমারজেন্সি জেনারেটর (২টি ৫০০ কেডিএ, ১১টি ১৫০ কেভিএ, একটি ১০০ কেভিএ) এটিএস ও ক্যানোপিসহ ১৪ সেট, ৭ কোটি ১০ লাখ; ২টি লিফট ও ৪০ কোটি কমিয়ে ৩৭টি লিফটের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২ কোটি ৩২ লাখ টাকা; কিন্তু ৩৫টির বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। (৮০০ কেজির ২০ স্টপ প্যাসেঞ্জার ২০টি, ১০০০ কেজির ২০ স্টপ ফায়ার কাম বেড লিফট ১১টি, ১২৫০ কেজির ৮ স্টপ ফায়ার কাম বেড লিফট ১টি, ১২৫০ কেজির ৭ স্টপ ফায়ার কাম বেড লিফট ১টি, ৮০০ কেজির ৩ স্টপ প্যাসেঞ্জার লিফট ২টি), ১১টি বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা সেট ৮টি, ৬২ লাখ; পিএবিএক্স এবং ইন্টারকম সিস্টেম ১টি, ২ কোটি ৩৮ লাখ; কম্পাউন্ড সিকিউরিটি লাইট ১টি, ২ কোটি ১৮ লাখ; সিসিটিভি সিস্টেম ৯৯০টি, ৩ কোটি ৫৫ লাখ এবং পাম্প মোটর সেট ৩১টির জন্য ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া জোন-ডি-তে ৬৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ১২৫০ বর্গফুট ফ্ল্যাটের ২০ তলা ৫টি ভবন, ২৫০০ বর্গফুটের ২ তলা ১টি চিলড্রেন ক্লাব হাউস এবং ১০০০ বর্গফুটের ৩টি গেট হাউস ভবন নির্মাণ করা হবে। একইভাবে জোন-সি-এর মতো বিভিন্ন ব্যয় ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়সাল হালিম বলেন, ‘আজিমপুর জোন-সি এই প্রকল্পের মাটি পরীক্ষা করে প্রস্তাবিত ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে। জোন-সি ও ডির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যতটুকু জানি জোন-সির ডিপিপি একনেক সভায় পাস হয়েছে।