‘আত্মগোপনে’ থেকে ভ্রমণ ভাতা নিচ্ছেন হিসাবরক্ষক

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৪:৫৭ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাচেষ্টা মামলায় আসামি হওয়ার পর টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের হিসাবরক্ষক মুহাম্মদ মজনু মিয়া আর অফিস করেননি। তবে তিনি গত এক বছরের বেশি সময় নিয়মিত তুলছেন বেতন। ‘আত্মগোপনে’ থাকলেও ভ্রমণে রয়েছেন জানিয়ে ছুটি নিয়ে তুলেছেন ভ্রমণ ভাতাও। এই হিসাবরক্ষক কর্মকর্তার প্রভাবের কারণে খোদ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তাকে ‘সব ব্যবস্থা’ করে দিয়েছে। ওই কর্মকর্তার বিভিন্ন নথি ঘেঁটে মিলেছে এ তথ্য। কাছে থাকা হাসপাতালটির স্বয়ংক্রিয় হাজিরা যন্ত্রের তথ্য, বেতন ও ভ্রমণ ভাতা নেওয়ার ফর্দ ও অফিস আদেশের কপি যাচাই করে দেখা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক দিনও হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেননি হিসাবরক্ষক মজনু মিয়া। ওই সময়ের মধ্যে তিনি দুই দফায় তিন মাস ও চার মাস করে সাত মাস ছুটি কাটিয়েছেন। তার আবেদনে দুই দফায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছুটির আবেদন মঞ্জুর করেছে। তবে মামলার আসামি হওয়ার পর তিনি তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়ার জন্য ছুটির দরখাস্ত দিলেও কর্তৃপক্ষ তার অসুস্থতাজনিত ধারায় অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করে। হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা মজনু এ ছুটিকেই আবার ভ্রমণ ছুটি দেখিয়ে তুলেছেন ৭২ হাজার ২০০ টাকার ভাতা! সেইসঙ্গে নিয়মিত বেতন-ভাতা হিসেবে তুলেছেন আরও ৫ লাখ ৯৫ হাজর ৯৯৭ টাকা। নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, সরকারি চাকরি বিধিমালার বাইরে গিয়ে মজনু এসব সুবিধা ভোগ করছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুসের সহায়তায়। হাসপাতালটির একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগের (বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ) সংসদ সদস্যের প্রভাবে হাসপাতালে নিজের কর্তৃত্ব গড়ে তুলেছিলেন হিসাবরক্ষক মজনু, যা তিনি পলাতক থাকা অবস্থায়ও বহাল রয়েছে। হিসাবরক্ষক পলাতক থাকায় প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বিভাগের দৈনন্দিন কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে। নিয়মিত অনেক কাজের জন্য ভোগান্তি পোহাতে হয় অন্য কর্মীদের। এর পরও তার বিরুদ্ধে কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মামলার পলাতক এই আসামিকে ছুটি ও ভ্রমণ ভাতা দিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালটির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মজনু অফিস না করেও সরকারের সব সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। সাত মাস তাবলিগে থাকার কারণ দেখিয়ে ছুটি নিয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারি চাকরির বিধিমালার কোথাও এ ধরনের নিয়ম নেই। মূলত তিনি মামলার আসামি হওয়ার পর তাবলিগের নামে আত্মগোপনে চলে যান। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন ব্যক্তি পলাতক থাকলেও মিথ্যাচারের মাধ্যমে সরকারি সুবিধা নিচ্ছেন। ছুটিও কাটাচ্ছেন আবার সেটার জন্য ভ্রমণ ভাতা নিচ্ছেন! তার এসব কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না। কারণ, হাসপাতালের সব থেকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা (পরিচালক) তাকে এসব সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন।’ অসুস্থতাজনিত ছুটির ধারায় তাবলিগ জামাতের ছুটি দিয়েছেন পরিচালক: চলতি বছরে দুইবার তাবলিগ জামাতে যাওয়ার জন্য হাসপাতালের পরিচালক বরাবর ছুটির আবেদন করেন মজনু মিয়া। প্রথম আবেদনে জানুয়ারির ১২ তারিখ থেকে এপ্রিল মাসের ১২ তারিখ পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় আবেদনে এপ্রিলের ১৫ তারিখ থেকে আগস্টের ১২ তারিখ পর্যন্ত ছুটি চান মজনু। আবেদন দুটির পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি মঞ্জুরের দুটি অফিস আদেশে বলা হয়, ‘ছুটি বিধি ১৯৫৯ সালের ৩(১) বি(২) ধারা মোতাবেক তাহার/তাহাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক (তাবলিগ জামাতে গমন) কারণে পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি মঞ্জুর করা হইল।’ অবশ্য হাসপাতালটির কর্মকর্তারা বলছেন, মজনুকে পরিচালক যে বিধি অনুযায়ী ছুটি মঞ্জুর করেছেন, সেটি অসুস্থতাজনিত ছুটির ধারা। এই ছুটি নিতে হলে অসুস্থতাজনিত চিকিৎসা সনদ দিতে হয়, যেটি মজনু মিয়া দিতে পারেননি। তা ছাড়া তাবলিগ জামাতে যাওয়ার জন্য একজন সরকারি কর্মচারী এতদিন ছুটি পান কি না এবং কোন বিধি ও নিয়ম অনুযায়ী সেই ছুটির জন্য ভ্রমণ ভাতা দেওয়া হলো, সেই প্রশ্নও উঠেছে। হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ‘নানা সমস্যার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অর্জিত ছুটি নিতে পারেন। উনি ছুটিতে আছেন এবং প্রার্থনা বা তীর্থ স্থানে যাওয়ার জন্য, পারিবারিক সমস্যার কারণে এ ধরনের ছুটি দেওয়া হয়েছে।’ ভ্রমণ ভাতা দেওয়ার বিষয়য়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘ভ্রমণ ভাতার বিষয়টি নিয়ে এ মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না। এটা জেনে বলতে হবে।’ জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ছুটির ব্যাপারটি কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা ও এখতিয়ারের ওপর নির্ভর করে। কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে তাহলে একটানা চার মাস অর্জিত ছুটি দিতে পারে। এটা আরও বিশেষ কিছু হলে টানা এক বছর পর্যন্ত গড়াতে পারে। তবে ছুটি নিতে হলে কর্মস্থলে উপস্থিত হতে হবে। কর্মস্থলে উপস্থিত না থেকে ছুটির আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না জানিয়ে এই জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ বলেন, এক বছরের বেশি সময় অনুপস্থিত থাকলে তিনি চাকরিতে অনিয়মিত বলে বিবেচিত হবেন। এ কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। ছুটিতে থাকা অবস্থায় সেটাকে ভ্রমণ দেখিয়ে ভাতা নেওয়ার কোনো উপায় নেই। এটা যদি নিয়ে থাকেন, তাহলে পুরো ব্যাপারটিই দুর্নীতি হবে। অনুপস্থিত থাকা ও ভাতা নেওয়ার বিষয়ে অবশ্য হিসাবরক্ষক মজনু মিয়া দাবি করেছেন, তিনি নিয়ম মেনে ছুটি কাটাচ্ছেন। ছুটি ছাড়া প্রতিদিন অফিসও করেছেন। আর ভ্রমণ ভাতা যা নিয়েছেন, সেগুলো ছুটির আগের সময়কার ভ্রমণ ভাতা। যদিও মজনুর কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত না থাকার বিষয়টি কাছে স্বীকার করেছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আব্দুল কুদ্দুস। তবে অনুপস্থিত এই কর্মচারী কীভাবে বেতন নিচ্ছেন, সে বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘ছুটির বাইরে তার অনুপস্থিতির বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি।’ মামলার পর দিন থেকেই ছুটি নেন মজনু: গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে পলাতক থাকলেও মজনুর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতাকে হত্যাচেষ্টা ও হামলার ঘটনায় টাঙ্গাইল সদর থানায় মামলা হয় এই বছরের ১১ এপ্রিল। এ মামলার ১০৫ নম্বর আসামি মজনু। মামলা হওয়ার তিন দিন পর তিন মাসের ছুটির আবেদন করেন তাবলিগ জামাতে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে। এই ছুটির আবেদন করার আগেও তিনি কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন না। ছুটি যেদিন আবেদন করেছেন সেদিনও উপস্থিত ছিলেন না। এর আগে জানুয়ারিতে একই কারণ দেখিয়ে তিনি চার মাস ছুটি কাটান। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জানিয়েছেন, এই মামলা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিজের নানা অপকর্মের কারণে পলাতক আছেন মজনু। টাঙ্গাইল সদর থানার ওসি তানবীর আহম্মেদ বলেন, এরকম একটা মামলা আছে। এসব মামলায় তো অনেক আসামি থাকে। মামলাটির তদন্ত চলছে। মামলার আসামি হওয়ার কথা স্বীকার করে হিসাবরক্ষক মজনু মিয়া দাবি করেন, প্রতিবেশী জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে এ মামলায় তার নাম দিয়েছে। নাম দেওয়ার আগে তার কাছে টাকাও চেয়েছিল। টাকা না দেওয়ায় আসামি করা হয়েছে।