চট্টগ্রামে দখল চাঁদাবাজি নিয়ে খুনোখুনি বাড়ছে

চট্টগ্রামে দখল-চাঁদাবাজি নিয়ে একের পর খুনের ঘটনা ঘটছে। চাঁদা না দিলেই নির্মমভাবে ছুরিকাঘাত কিংবা গুলি করতে দ্বিধাবোধ করছে না সন্ত্রাসীরা। তাদের হাত থেকে ব্যবসায়ী তো বটেই, সাধারণ ভ্যানগাড়ি মেকানিক; কেউই বাদ যাচ্ছে না। এদের মধ্যে অনেকের রাজনৈতিক দলের পদ-পদবি থাকায় গ্রেফতার করছে না বলে অভিযোগ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, হত্যা মামলার ওয়ারেন্টভুক্ত আসামিও ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রকাশ্যে! এতে করে বিচারপ্রার্থীদের দিন কাটছে আতঙ্কে। ভুক্তভোগীরা অপরাধীদের বিরুদ্ধে মুখ খোলা দূরের কথা, থানা-পুলিশের কাছেও অভিযোগ দিতে সাহস পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশ এখনো আগের মতো সক্রিয় না হওয়ায় সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অপরাধীরা। এদিকে নগরীতে চাঁদাবাজি, হুমকিসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গত ২৪ আগস্ট ‘হ্যালো সিএমপি’ অ্যাপসে তথ্য দেওয়ার জন্য নগরবাসীর সহযোগিতা চেয়েছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। এরপর গত ১১ দিনে ৭৪টি অভিযোগ জমা দিয়েছে নগরবাসী। তবে এসব অভিযোগ নিয়ে এখনো কাজ শুরু করেনি পুলিশ। গত ২৩ জুলাই নগরীর কালুরঘাট এলাকার বালু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন সাজ্জাদ আলী ওরফে বড় সাজ্জাদ। বিদেশ থেকে ওই ব্যবসায়ীর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে কল করে এই চাঁদা দাবি করা হয়। না দেয়ায় গত ১ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর চান্দগাঁও থানার মোহরা এলাকায় মোহাম্মদ ইউনূসের বাসায় হানা দেন তার অনুসারীরা। ওই ব্যবসায়ীর হাঁটু, কোমর, পাসহ শরীরের চারটি স্থানে গুলি লাগে। তবে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। বিদেশে বসে চট্টগ্রামের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন এই বড় সাজ্জাদ। চাঁদা না পেলেই তার অনুসারীরা গুলি ছুড়ছেন। এর আগে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার কালারপুল এলাকায় শটগান হাতে সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদসহ আরও দুজন গুলি করতে করতে একটি নির্মাণাধীন ভবনে প্রবেশ করে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। গত ২১ অক্টোবর চান্দগাঁও থানা এলাকার শমশেরপাড়ায় প্রকাশ্যে গুলি করে আফতাব উদ্দিন তাহসিন (২৬) নামের এক যুবককে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ও বাবলা গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধের জেরে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটে। তাহসিন বাবলা গ্রুপের সদস্য ছিলেন। এরপর গত ৩০ মার্চ রাতে নগরীর বাকলিয়ার এক্সেস রোডে প্রাইভেটকারে গুলি করে হত্যা করা হয় বখতিয়ার হোসেন ও আবদুল্লাহ নামের দুই ব্যক্তিকে। তারাও বাবলার অনুসারী হিসাবে পরিচিত। একই গাড়িতে বাবলা থাকলেও অল্পের জন্য রক্ষা পান। তার বিরুদ্ধে বালুমহাল দখল, নির্মাণাধীন ভবন, বাসাবাড়ি, এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ফুটপাতে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। সর্বশেষ ৮ সেপ্টেম্বর নগরীর বাকলিয়া থানাধীন শান্তিনগর এলাকায় ছুরিকাঘাতে শাহজাহান মিয়া ওরফে সাজন মিয়া (৩৫) নামে এক গ্যারেজ মালিককে হত্যা করে চাঁদাবাজরা। তারা সাজন মিয়ার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছিল বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে। প্রকাশ্যে ঘুরছে ঘাতকরা : গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন পাঠানিয়া গোদা এলাকায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের টার্ফ (কৃত্রিম ঘাস) মাঠ দখল নিয়ে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছিল জুবায়ের উদ্দিন বাবু (২৬) নামে এক যুবক। ওই ঘটনায় চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের বিলুপ্ত কমিটির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক নুরুল আমিন, চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের চান্দগাঁও থানা কমিটির আহ্বায়ক মো. আলফাজসহ ৪০ জনের নাম উল্লেখ করে ৭০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এদের মধ্যে অনেকেই ঘুরছে প্রকাশ্যে। জুবায়ের হত্যা মামলায় এ পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০ আগস্ট আবির রহমান রুবেলকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৭। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খুনের ঘটনার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছিলেন জুবায়ের হত্যা মামলার আসামিরা। তবে নির্ধারিত সময়ের পর নিু আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর পরও প্রকাশ্যে ঘুরছে অনেক ঘাতক। কেবল তাই নয়, গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়েই দখল-চাঁদাবাজি করছে অনেকে। জানা যায়, গত ১৩ জুলাই জুবায়ের হত্যা মামলার আসামি মো. আলফাজের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। অথচ ২৭ আগস্ট রাত ১০টায় দলবল নিয়ে চান্দগাঁও থানার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মালির বাড়ির আবসারের জায়গা দখল করতে যায় আলফাজ। এর আগে গত বছরের ২১ আগস্ট বরিশাল বাজারের রায়হান নামে এক ব্যবসায়ীর বাসা থেকে নগদ টাকা লুট করেছিল আলফাজ, দুলাল, তারেক ও জাহেদ। ২০ দিন পর আবারও চাঁদা দাবি করলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের কাছে গিয়ে আইনগত সহায়তা চায় ভুক্তভোগী রায়হানের স্ত্রী। না পেয়ে পরে এলাকা ছেড়ে চলে যান ব্যবসায়ী রায়হান। বর্তমানে তিনি ইপিজেড এলাকায় একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করছেন। এছাড়া চাঁদা না দেওয়ায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর বক্কর নামে এক ভুক্তভোগীর বাড়িঘর ও গাড়ি ভাঙচুর করে আলফাজ। তার বিরুদ্ধে সৎবোনকে হত্যার মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালে রাফিদা আক্তার নিহার নামে সৎবোনকে হত্যা করেছিল আলফাজ। তার সৎমা খালেদা আকতার বাদী হয়ে তখন হত্যা মামলা করেছিলেন। দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট আবদুর রহমান ওরফে আলফাজকে প্রধান আসামি করে আদালতে চার্জশিট দিয়েছিল পুলিশ। স্থানীয় সূত্র জানায়, গত ২৯ আগস্ট আলফাজকে তার নিজ বাসা চান্দগাঁও থানার ৪নং ওয়ার্ডে অবস্থিত রিয়াজ উদ্দিন উকিল বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছেন স্থানীয়রা। পরদিন চান্দগাঁও এলাকার পিজাবিডি নামক একটি রেস্টুরেন্টে নাস্তা করতেও দেখা যায় তাকে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকালেও আলফাজকে তার বাসা থেকে বের হতে দেখেছেন স্থানীয়রা। এ সময় জুবায়ের হত্যা আসামি পারভেজ মোটরসাইকেলে করে তাকে বরিশাল বাজারে নিয়ে যেতে দেখা যায়। জুবায়ের হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চান্দগাঁও থানার এসআই জায়েদ আবদুল্লাহ বিন ছরওয়ার বলেন, ‘বাদীর সহযোগিতা না পাওয়ায় আসামিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’ জানতে চাইলে সিএমপির এডিসি-পিআর শ্রীমা চাকমা বলেন, ‘হ্যালো সিএমপিতে দেওয়া অভিযোগগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। এসব বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।’ ওয়ারেন্টের আসামি প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের কাছে অপরাধীর কোনো ভিন্ন পরিচয় নেই এবং গ্রহণযোগ্য নয়। ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি সে যে দলেরই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।