নেপালে কারফিউ, আতঙ্কিত জনগণ

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৬:৪৭ অপরাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাস্তায় গাড়ি নেই। মানুষেরও দেখা মিলছে না। রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর এখন কারফিউ চলছে নেপালজুড়ে। অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে চাপা আতঙ্ক কাজ করছে নেপালবাসীর মধ্যে। যদিও পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। বুধবার সকাল থেকে নেপালে বড় ধরনের কোনো অশান্তির ঘটনা না ঘটলেও চলছে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। কাঠমান্ডুর পাশের জেলায় সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নেপালের দায়িত্ব নিয়ে নেপালের সেনাবাহিনী এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, যত দিন পর্যন্ত না নতুন সরকার গঠিত হচ্ছে, তত দিন দেশের শাসনভার চালাবে তারা। কারফিউ দিয়ে নতুন সরকার গঠনের চেষ্টা চলছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আলোচনায় আছেন কাঠমান্ডুর সিটি মেয়র বালেন্দ্র শাহ। মঙ্গলবার দুপুরে দেশটির রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেলের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কেপি অলি। এরপর শোনা যায় হেলিকপ্টারে নেপাল ছেড়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। আশ্রয় নিয়েছেন কাতারে। পরে স্থানীয় সাংবাদিক প্রজ্জল অলির মাধ্যমে জানা যায়- নেপালেই আছেন তিনি। নেপাল স্পোর্টস জানালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রজ্জল অলি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়েননি। এই মুহূর্তে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় তাদের ব্যারাকে আছেন। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে অনেক মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা আশ্রয় নিয়েছেন। যেমনটা বাংলাদেশে হয়েছিল ২০২৪ সালের আগস্টে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশে সরকার পতনের পর অনেক মন্ত্রী, আমলা ও প্রসাশনের অনেকেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। ছাত্র-যুব আন্দোলনে সোমবার এবং মঙ্গলবার দফায় দফায় উত্তেজনা ছড়ায় নেপালে। কাঠমান্ডু থেকে বিদ্রোহের সূত্রপাত হলেও তা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে নেপালজুড়ে। হাজার হাজার বিদ্রোহী হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে স্লোগান। দফায় দফায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান তারা। মঙ্গলবার রাতেই আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নেপালের সেনাপ্রধান অশোকরাজ সিগডেল। বিক্ষোভকারীদের দাবি-দাওয়া কী, তা জানাই উদ্দেশ্য ছিল ওই বৈঠকের। কাঠমান্ডু পোস্টের সাংবাদিক দীপক পাউডেল জানিয়েছেন, বুধবার নেপালের রাষ্ট্রপতি রামচন্দ্র পাউডেলের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের প্রতিনিধি দলের বৈঠকে বসার কথা। সেই বৈঠকে মধ্যস্থতা করবে নেপালের সেনাবাহিনী। আশা করা হচ্ছে, ওই বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। তৈরি হতে পারে নতুন মন্ত্রিসভা। নেপালে পুরোনো প্রজন্মের রাজনীতিবিদদের প্রতিনিধিত্ব করেন কেপি শর্মা ওলি, শের বাহাদুর দেউবা, পুষ্পকমল দাহাল (প্রচন্ড) প্রমুখ। তরুণদের ওপর গুলি চালানোর মতো সহিংস দমননীতি অনুসরণ করে ওলি সরকার নিজের পতনের পথ নিজেই তৈরি করে দেয়। সরকারবিরোধী এ আন্দোলনের নেপথ্যে অন্যতম কারিগর কাঠমান্ডুর সিটি মেয়র বালেন্দ্র শাহ। ২০২২ সালে স্বতন্ত্রভাবেই মেয়র নির্বাচিত হন ৩৫ বছরের এই তরুণ তুর্কি। তাকে নিয়েই এখন স্বপ্ন দেখছেন জেন- জি প্রজন্ম। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া তরুণরা এখন সরাসরি কাঠমান্ডুর মেয়র বালেন্দ্র শাহের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন- এসো বালেন্দ্র, আমাদের এই সংকট থেকে রক্ষা করো। তারা জানিয়েছেন- এবারের আন্দোলন শুধু সরকারের বিরুদ্ধে নয়- এটি একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য সংগ্রাম। এই সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হবে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও নৈতিকতা। আর সেই নতুন নেপালের চালকের আসনে গোটা জাতি বালেন্দ্র শাহকে দেখতে চায়। আগের দিনের মতোই বন্ধ রয়েছে সব দোকানপাট বিপণিবিতান। অফিস আদালতও খোলেনি। থামেলে সকালে দুই-একটি দোকান খুললেও পরে সেনাবাহিনী তা বন্ধ করে দিয়েছে। মোড়ে মোড়ে টহল দিচ্ছে সেনা সদস্যরা। জটলা দেখলে সরিয়ে দিচ্ছে তাদের। মার্কেট কবে খুলবে তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জানা গেছে, দুই-এক দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হতে পারে পরিস্থিতি। খুলতে পারে দোকানপাট। এতে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন পর্যটকর। নেপানল হোটেল অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে নেপালের কাঠমান্ডুর বিভিন্ন হোটেলে বিভিন্ন দেশের অন্তত লক্ষাধিক পর্যটক আটকা আছেন। এর বেশিরভাগ উঠেন কাঠমান্ডুর থামেলে। থামেলের আশপাশেই ভারত, লাওস, সিশেলস, মরোক্কোসহ বিভিন্ন দেশের দূতাবাস। আগের দিনের জেন-জিদের আক্রমণে আক্রান্ত হয়েছে এসব দূতাবাস। আগুন দেওয়া হয় মরোক্কান দূতাবাসে। হামলার শিকার হয়েছে সাত তারকা হোটেল হিলটন হোটেলও। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের মালিকাধীন হোটেল হওয়াতে এখানে হামলা করেন আন্দোলনকারীরা। এই হোটেলে আটকা পড়েছেন অনেক বাংলাদেশি পরিবার। অন্য জায়গাগুলোর মতো দেশের সুপ্রিম কোর্টেও আগুন লাগিয়ে দেওয়ার খবর মেলে। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযোগে নেপালের জেলগুলোতে বিদ্রোহের আগুন ছড়ায়। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বন্দিদের সংঘর্ষের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। জেল ভেঙে পালানোর চেষ্টা করেন হাজার হাজার বন্দি। প্রতিরোধ করতে গেলে আক্রান্ত হন নিরাপত্তারক্ষীরা। পাল্টা গুলিও চালান তারা। স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানা গেছে, কারাগার থেকে পালানোর সময় গুলি চালায় পুলিশ। তাদের গুলিতে সাতজন আহত হন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বুধবার পাঁচজনের মৃত্য হয়। এখনও পর্যন্ত ২৬০০ জন বন্দি বিভিন্ন জেল থেকে পালিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নেপালের বিভিন্ন দিকে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সংবেদনশীল এলাকায় টহল দিচ্ছে সেনাবাহিনী। এদিকে নেপালের একাধিক সংবাদমাধ্যমের দাবি, সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান চালিকাশক্তি বছর ছত্রিশের এক তরুণ, নাম সুদান গুরুং। ২০১৫ সাল থেকে ‘হামি নেপাল’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালান। মূলত ছাত্র-যুবকদের দ্বারা পরিচালিত এই সংগঠন দীর্ঘ দিন ধরেই নেপালের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে শিক্ষার প্রসারে কাজ করে থাকে। এক সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ‘ডিস্ক জকি’ বা ‘ডিজে’ হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন সুদান। ২০১৫ সালে একটি ভূমিকম্পে এক সন্তানকে হারান তিনি। তারপরেই স্থির করেন নেপালে তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে কাজ করবেন তিনি। ২০১৫ সালের পরেই সুদান ত্রাণ এবং বিপর্যয় মোকাবিলার কাজে হাত পাকাতে থাকেন। স্থানীয় স্তরে মেলামেশার ফলে নেপালের ছাত্র-যুবদের কাছে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। সুদানের সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্টে জ্বলজ্বল করছে তার ডিজে পরিচয়। তিনি গান বাজাচ্ছেন- এমন ভিডিও রয়েছে সেখানে। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে তার অংশগ্রহণের ছবিও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে দক্ষ এই সুদানই এখন নেপাল সরকারের কাছে মাথাব্যথার কারণ। সমাজমাধ্যমের মাধ্যমেই তিনি নেপালের ছাত্র-যুবকদের একাংশের কাছে নিজের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ‘টিকটক’-এর মতো যে অ্যাপগুলো সরকারি বিধিনিষেধের মুখে পড়েনি, সেগুলোর মাধ্যমেই আন্দোলনকারীরা পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়িয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।