এটর্নি জানারেলের আত্মতুষ্টি আর একটি লাশের জনপদের গল্প

১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৯:২৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি ক্রমশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, যা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবকাঠামোর জন্য একটি গুরুতর হুমকি। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে মব লিঞ্চিং, হত্যা, ধর্ষণ এবং নদীতে লাশ ভাসানোর মতো অপরাধের হার অভূতপূর্বভাবে বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান “গত এক বছরে একটাও গুম হয়নি” বক্তব্যটি শুধু অস্বীকারাত্মক নয়, বরং জনগণের সাথে বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। এই ঘোষণা গুমের মতো রাষ্ট্রীয় অপরাধের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, কিন্তু বর্তমানের অরাজকতা—যেমন মব হত্যা, ধর্ষণ এবং অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা—এর চেয়েও লঘু অপরাধ নয়, বরং সমাজের গভীর অস্থিরতার সূচক। এই বক্তব্যটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা প্রকাশ করে এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে। প্রথমত, গত এক বছরে (২০২৪-২০২৫) মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনা একটি ভয়াবহ মাত্রা লাভ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (এএসকেআর) এর রিপোর্ট অনুসারে, ২০২৪ সালে ১২৮ জন মব সহিংসতায় নিহত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। কানাডা-ভিত্তিক গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্র্যাটিক গভর্ন্যান্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৬৩৭ জন মব লিঞ্চিংয়ে নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৪১ জন পুলিশ সদস্য। এই হত্যাকাণ্ডগুলো প্রায়শই চুরি, ধর্মীয় অভিযোগ বা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে ঘটেছে, এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে। এই হত্যাগুলো গুমের চেয়ে লঘু নয়; বরং এগুলো স্পষ্ট সহিংসতা, যা রাষ্ট্রের অক্ষমতা প্রমাণ করে। অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এই হত্যাকাণ্ডের প্রতি অন্ধত্ব প্রদর্শন করে, যা জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াচ্ছে। দ্বিতীয়ত, নদীতে লাশ ভাসানোর ঘটনা একটি চিন্তাজনক প্রবণতা দেখাচ্ছে, যা অপরাধের গভীরতা প্রকাশ করে। রিভার পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালে প্রতি মাসে গড়ে ৪৩টি লাশ উদ্ধার হয়েছে, যার ৩০% অজ্ঞাত। ২০২৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৬টি প্রতি মাসে। এই লাশগুলোর মধ্যে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডের ফল, যা অপরাধীরা নদীকে লাশ ফেলার জায়গা হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি গুমের মতোই ভয়াবহ, কারণ এতে পরিবারেরা তাদের প্রিয়জনের খোঁজ পায় না এবং বিচার হয় না। অ্যাটর্নি জেনারেলের “একটাও গুম হয়নি” ঘোষণা এই অজ্ঞাত লাশের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে অস্বীকার করে, যা রাষ্ট্রের তদন্তের অভাবকে উন্মোচিত করে। এই পরিস্থিতি সমাজে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে এবং আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা প্রমাণ করেছে। তৃতীয়ত, ধর্ষণের ঘটনা একটি মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এএসকেআরের তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের প্রথম সাত মাসে ৩০৬টি মেয়ে শিশুর ধর্ষণের ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে, যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের সংখ্যা (২৩৪) অতিক্রম করেছে। ইউনিসেফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ ২০২৫ পর্যন্ত ৫০টি শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া, ২০২৪ সালে ৪,২০০টিরও বেশি ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মামলা রেকর্ড হয়েছে, যার মধ্যে ৬৫০টি গ্যাং রেপ। আচিয়া ধর্ষণ-হত্যা ঘটনা (২০২৪ সালের একটি ভয়াবহ ঘটনা, যেখানে একটি শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়) জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে এবং সমাজের নৈতিক অবক্ষয় প্রকাশ করেছে। এই অপরাধগুলো গুমের চেয়ে কম গুরুতর নয়; বরং এগুলো শারীরিক ও মানসিকভাবে ভয়াবহ, এবং রাষ্ট্রের অক্ষমতা এই হিংসাকে উৎসাহিত করছে। অ্যাটর্নি জেনারেলের আত্মতুষ্টি এই পরিস্থিতির মুখে অস্বাভাবিক, যা নারী ও শিশু নিরাপত্তার প্রতি অবহেলা প্রকাশ করে। সার্বিকভাবে, বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ২০২৫ সালে অবনতির দিকে এগোচ্ছে। হোম অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার লেফটেন্যান্ট জেনারেল (রিট.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বীকার করেছেন যে পরিস্থিতি “সামান্য খারাপ হয়েছে”, কিন্তু অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য এই স্বীকৃতিকে অস্বীকার করে। মব হত্যা, নদীতে লাশ ভাসানো এবং ধর্ষণের মতো অপরাধগুলো গুমের চেয়ে লঘু নয়; এগুলো সমাজের গভীর অস্থিরতা এবং রাষ্ট্রের ব্যর্থতার ফল। অ্যাটর্নি জেনারেলের এই আত্মতুষ্টি জনগণের ভয় এবং হতাশাকে উপেক্ষা করে, যা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করছে। এই বক্তব্যটি শুধু অসত্য নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার প্রতীক, যা দ্রুত সংস্কারের দাবি জানায়। সরকারকে অবিলম্বে পুলিশ সংস্কার, দ্রুত বিচার এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, অন্যথায় এই অরাজকতা দেশকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেবে।