অবরুদ্ধ বাংলাদেশ

এজাজ মামুন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) অডিটোরিয়ামে মঞ্চ ৭১ আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় গতকাল যে ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটেছে তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির গভীর সংকটকে পুনরায় প্রকাশ করেছে। ‘স্বাধীনতাযুদ্ধ ও আমাদের সংবিধান’ শীর্ষক এক আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, দেশের প্রাক্তন আইন প্রণেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও বিশিষ্টজনদের উপর সংগঠিত হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। অনেকেই গুরুতর আহত হন। আরও অবিশ্বাস্য হলো—এই মব সন্ত্রাসিরা বিশিস্টজনদের পুলিশে সোপর্দ করে, আর পুলিশ হামলাকারীদের গ্রেপ্তার না করে উল্টো ভুক্তভোগীদেরকেই জেলে পাঠায়। এই ঘটনা কেবল সহিংসতা নয়, এটি বিচারহীনতার নগ্ন প্রদর্শনী এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পুনরুত্থানের প্রমাণ। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে—স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমতার স্বপ্ন নিয়ে। সেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করেই সংবিধান রচিত হয়েছে। কিন্ত ঢাকায় মঞ্চ ৭১ আয়োজিত আলোচনায় দুর্বৃত্তদের হামলার ঘটনায় দেখা গেল, মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ এবং সংবিধান রক্ষার মানুষের প্রত্যয়কেই লক্ষ্য করে আঘাত হানা হয়েছে। গত একবছরের কিছ বেশি সময় ধরে ঘটে যাওয়া মব সন্ত্রাসের মত এখানেও আসলে বাংলাদেশবিরোধী ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি তাদের উত্থানকে ও শক্ত অবস্থানকে জানান দিয়েছে, ও তারা তাদের শক্তি প্রদর্শন করেছে। মানুষের কণ্ঠরোধ করে তারা প্রমাণ করতে চাইছে যে, এই ভূখণ্ডে মুক্তচিন্তা, ভিন্নমত কিংবা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ আর নিরাপদ নয়। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সহিংসতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক অর্জনকে ধ্বংস করার প্রকল্পের অংশ। আজ অবরুদ্ধ এক সাংবাদিক কারাবাসের যাত্রাপথে জাতির কাছে প্রশ্ন করছেন, “মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কথা বলা কি সন্ত্রাস করা?” একজন আইনের অধ্যাপক কারাগারে যাবার পথে সংবিধান রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যদি মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান রক্ষার কথা বলার কারণে আজ কেউ দমননীতির লক্ষ্য হয়, তবে এটি জাতির আত্মপরিচয়ের উপর সরাসরি আঘাত। ডিআরইউতে হামলা কেবল কিছু মানুষের উপর আক্রমণ নয়—এটি মুক্তবুদ্ধি, মতপ্রকাশের অধিকার ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের উপর আঘাত। এর মাধ্যমে পুরো সমাজকে বার্তা দেওয়া হয়েছে: ভিন্নমত প্রকাশ করলে আপনিও হামলার শিকার হতে পারেন, এমনকি আইনও আপনার পাশে থাকবে না। এটি ড. ইউনূসের স্বৈরতান্ত্রিক শক্তিকে টিকিয়ে রাখতে এবং বাংলাদেশ বিরোধী শক্তিকে সবার কাছে উন্মুক্ত করতে এই ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত তা শাণিত করা হচ্ছে । বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক সহিংসতা নতুন নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ক্রমেই গভীর হচ্ছে । ডিআরইউতে হামলার ঘটনা প্রমাণ করে যে, হামলাকারীরা জানে—তাদের শাস্তি হবে না। কারণ ড. ইউনূসের অধীনে রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিবারই ভুক্তভোগীর বদলে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ডিআরইউর এই ঘটনা স্পষ্ট করে দেয়—বাংলাদেশ আজ কার্যত অবরুদ্ধ। গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার যখন দমন করা হয়, তখন রাষ্ট্র এক অদৃশ্য শিকলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া সংবিধান যেখানে নাগরিক অধিকার রক্ষার অঙ্গীকার করেছে, সেখানে সংবিধান রক্ষার আলোচনাই যদি অপরাধ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা একটি অবরুদ্ধ জাতিরই লক্ষণ। হামলার শিকারদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে, অথচ হামলাকারীরা অক্ষত রয়েছে। এতে এটাই প্রমাণ করে আইন, বিচার ও রাষ্ট্রযন্ত্র একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে বন্দি হয়ে আছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান রক্ষার প্রত্যয় দমনের মাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠী তাদের ক্ষমতার বার্তা দিচ্ছে। এই বার্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই একদিন প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে, মানুষ বুঝে গেছে—বাংলাদেশ আজ অবরুদ্ধ, আর এই অবরোধ ভাঙতে হলে জাতিকে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।