নিরাপদ নন সাধারণ মানুষ

৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ | ৮:৪১ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে একের পর এক ঘটছে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কোনোভাবেই থামছে না মব ভায়োলেন্স (গণসহিংসতা)। সেই সঙ্গে বাড়ছে ‘নানা দাবি’ আদায়ের আন্দোলনও। পাশাপাশি খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, অপহরণ, চুরি এবং চোরাচালানসহ নানা ঘটনায় দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। সবমিলিয়ে নিরাপদ নন সাধারণ মানুষ। ‘ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার’ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঠে থাকলেও পরিস্থিতির কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। এত ক্ষমতা থাকার পরও কেন পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না-তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সন্ত্রাস-সহিংসতা ও অপরাধ দমনে পুলিশ কার্যত পুরোদমে কঠোর ভূমিকা পালন করতে না পারার কারণেই মূলত এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের আরও অভিমত-এক ধরনের ট্রমায় ভুগছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য। অর্থাৎ মব আতঙ্কে ভুগছেন তাদের অনেকে। এছাড়া আরও দুটি কারণে কার্যত পুরোদমে সক্রিয় হচ্ছেন না তারা। এর একটি হচ্ছে-সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার নীতি। অর্থাৎ কোথাও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে নানা শঙ্কা থাকে। পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকে আগের মতো স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তির সহযোগিতা না করা। মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার মুখ্য দায়িত্ব যে বাহিনীর, সেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। গত এক বছর এক মাসে ৩৩৪টি গণসহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ২১৯টিতেই ভিকটিম হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। আর থানা আক্রমণ হয়েছে ১২টি। আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ৫৭টি ঘটনায়। এছাড়া অন্যান্যভাবে পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে ১৫০টি। এছাড়া ছাত্র দেখলেই পুলিশের মনে এখনো ভয়ভীতি কাজ করে। জানতে চাইলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচ্চপর্যায়ের সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে শতভাগ সফল হওয়া যাচ্ছে না। কারণ, বতর্মান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কারও মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে চায় না। এ কারণে বেশির ভাগ সময়ই পুলিশ অ্যাকশনে যেতে পারে না। আর পুলিশের এই দুর্বলতার কারণে একের পর এক আন্দোলনের নামে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে অপশক্তি। ওই সূত্র জানায়, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় থাকলে মবসহ নানা অপরাধ দমনে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন রাজনৈতিক দলের নেতা। বিশেষ করে সংসদ-সদস্য, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাস্তব পরিস্থিতির কারণেই তাদের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে অস্থিরতাসহ নানা অপরাধ দমন করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যতটুকু ঘাটতি আছে সেই ঘাটতি কাজে লাগিয়ে নানা ভাবে মব, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, সংঘাত-সহিংসতাসহ নানা অপরাধ ঘটানো হচ্ছে। এই জায়গাগুলোতে আরও বেশি অগ্রগতি হতে পারত। বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, একটি দল ক্ষমতায় আসছে-এমন হাওয়া তৈরি হওয়ায় পুলিশ তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দমন করতে পারছে না। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অন্যতম কারণ এটি। কেননা যখন লোক দেখে রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনায় আইন প্রয়োগ করা হবে তখন অপরাধীরা সেটা বড় সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করবে। কারও কর্মস্থল, কারও বাড়ি ভাঙচুর, দখল, চাঁদাবাজি করবে। এদিকে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশের প্রতি মানুষের অনেক ক্ষোভ ছিল। তাই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাধারণ মানুষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় পুলিশ। এতে পুলিশ মানসিকভাবে ব্যাকফুটে চলে যায়। সেই সুবাধে অপরাধী ও সুযোগসন্ধানীরা তৎপর হয়ে উঠে। গত এক বছরে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হয়েছে। দ্রুতই আরও উন্নতি হবে বলে আশা করছি। পুলিশ সদর দপ্তরের তৈরি করা সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সারা দেশে দুই হাজার ২১৬টি মামলা হয়েছে। একই সময়ের মধ্যে দেশে ৪২৬টি ডাকাতি, ৬২৫টি অপহরণ, ৫৩৮৭টি চুরির ও ১০১০৯টি চোরাচালানের মামলা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ৪৯২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে ২৯টি, কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ৬১ জনের। এ সময়ে আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৬৫ সাংবাদিক। রাজনৈতিক সহিংসতায় হতাহত হয়েছেন ছয় হাজার ৩৯০ জন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৮৮ জন নারী। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ১০৮ জনের। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৮ জন। এছাড়া যৌতুক ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৩৩ নারী। সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মাজারে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে ৮০টি। অন্যান্য মব ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে ৩৫টি। তবে সবগুলো ঘটনায় মামলা বা জিডি হয়নি। চারটিতে নিয়মিত মামলা হয়েছে এবং পাঁচটি ঘটনায় জিডি এন্ট্রি হয়েছে। এছাড়া ৩৩৪টি গণসহিংসতার মধ্যে ৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ঘটনাতেই ভিকটিম হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। মাজারে হামলার ঘটনা ঘটেছে ২৩ দশমিক ৯৫ ভাগ। আর অন্যান্য হামলার ঘটনা ঘটেছে ১০ দশমিক ৪৭ ভাগ। পুলিশের ওপর যেসব মব ভায়োলেন্স হয়েছে সেগুলোর মধ্যে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ২৬ দশমিক শূন্য ২ ভাগ ঘটনায়। থানা আক্রমণ ও ঘেরাওয়ের ঘটনা ঘটেছে ৫ দশমিক ৪৭ ভাগ। আর অন্যান্যভাবে পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে ৬৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ ঘটনায়। পুলিশ আক্রান্তের ২১২৯টি ঘটনার মধ্যে ৩১৩টি ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য ৩৫টি মবের ঘটনায় ৩৪টিতে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে বুধবার রাতে রাজধানীর মালিবাগে সোহাগ পরিবহণের পরিচালক আলী হাসান পলাশ তালুকদারের বাসা ও সোহাগ পরিবহণের দুটি কাউন্টারে হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। কাউন্টারে বাসের অপেক্ষায় থাকা নারী ও শিশুসহ অন্যরা আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকেন। এ ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হন। সোমবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ সময় আল-আমিন নামে আদাবর থানার এক পুলিশ কনস্টেবল ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি কোপে জখম হন আরও কয়েকজন। এর আগে গত ১২ মার্চ মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাসহ পাঁচ মামলার আসামি গোলাম মোস্তফাকে গ্রেফতার করতে গিয়ে মবের শিকার হয় পুলিশ। এ সময় ‘মব সৃষ্টি’ করে পুলিশকে মারধর করে আসামি ছিনিয়ে নেয় একদল দুর্বৃত্ত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২২ এবং ২৩ আগস্ট-এই দুদিনে চারটি চাঞ্চল্যকর গণসহিংসতার ঘটনা ঘটে। গত ২২ আগস্ট ময়মনসিংহের কৃষ্টপুর এলাকায় মব দমন করতে গিয়ে কোতোয়ারি থানার এসআই নাজমুল এবং কনস্টেবল এরশাদসহ তিনজন আহত হন। ওইদিন চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে চোর সন্দেহে তিন কিশোরকে আটক করে এলাকাবাসী। পরে মবের শিকার হয়ে নিহত হন কিশোর মাহিন (১৫)। মব সৃষ্টিকারীদের কিলঘুষি ও লাথিতে আহত হন অপর দুই কিশোর মানিক ও রাহাত। পরদিন ২৩ আগস্ট রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানা এলাকায় গণসহিংসতার শিকার হন ডিবির বহিষ্কৃত এসআই মাহবুব হাসান। ওইদিন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি ধরতে যায় এএসআই দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বাধীন পুলিশের একটি দল। আসামি ফারুক হোসেনকে গ্রেফতার করে থানায় নেওয়ার সময় হামলার শিকার হন পুলিশ সদস্যরা। একপর্যায়ে হামলাকারী পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নেয়। গত ৩১ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত সন্ত্রাসী ঘটনা দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এ ঘটনার উসকানিদাতা হিসাবে বিএনপি নেতা কুসম বড়ুয়া এবং যুবলীগ নেতা হানিফ ও ইকবালকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ইতোমধ্যেই কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। অপরদিকে ভিসি, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, একাডেমিক কাউন্সিলর এবং দুজন অন্তঃসত্ত্বা শিক্ষকসহ ২১০ জনকে অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনায় উসকানিদাতা হিসাবে নয়জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জানা গেছে, ৭ আগস্ট গাজীপুর নগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও ছিনতাইকারী দলের সদস্যরা সাংবাদিক আসাদুজ্জামানকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ইটপাথরের খণ্ড দিয়ে আঘাত করে তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়।