টিসিবির তালিকা থেকে বাদ পড়লেন বিধবা-প্রতিবন্ধীরা

ট্রাক দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছেন মাসদার আলী (৫০)। এখন এক পায়ে ভর করেই বাজারে ঝাড়ু দেন তিনি। মাস শেষে পান মাত্র সাড়ে চার হাজার টাকা। সেই টাকায় কোনোমতে সংসার চলে। আগে টিসিবির একটি কার্ড ছিল প্রতিবন্ধী মাসদারের। ন্যায্যমূল্যে কিছু খাদ্যসামগ্রী পেলে সংসারে খানিকটা স্বস্তি মিলত। কিন্তু প্রায় ৯ মাস আগে এলাকার সবার কার্ড জমা নেওয়ার পর নতুন তালিকা করা হয়। সে তালিকায় নাম নেই মাসদারের। হাতে পাননি নতুন কার্ডও। মাসদারের বাড়ি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ৩ নম্বর ওয়ার্ডে। প্রায় ১০ মাস আগে এ ওয়ার্ডের সবার টিসিবি কার্ড স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে জমা নেওয়া হয়। তখন থেকেই টিসিবির পণ্য বিতরণ বন্ধ। এরপর গত বছরের শেষের দিকে নতুন তালিকা করার জন্য স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে সিটি করপোরেশন। সেই কমিটি তালিকা তৈরি করে কিছু মানুষকে কার্ড দিলেও বাদ পড়েছেন মাসদারের মতো অনেক প্রতিবন্ধী, দিনমজুর ও দরিদ্র মানুষ। মাসদার আক্ষেপ করে বলেন, আমি প্রতিবন্ধী মানুষ। সবাই আমাকে ভালোবাসে, সাহায্য করে; কিন্তু এবার যে টিসিবির তালিকা থেকে আমাকে বাদ দেওয়া হবে, তা কল্পনাও করিনি। গত ১০ মাস ধরে একজন মানুষও কোনো মালপত্র পায়নি। সবকিছু বন্ধ। শুধু মাসদার নন, একই হতাশা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধ আজাদ আলী (৬০)। তিনি বলেন, এ বয়সেও রংমিস্ত্রির কাজ করি। সংসার চালানোর জন্যই করছি। আমার কার্ড বাতিল হলো কেন? আমি তো কোনো রাজনীতি করি না। আমার কার্ডটা বাদ দেওয়া কি ঠিক হলো? তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন বিধবা নিলুফা বিবিও (৬৫)। তার অভিযোগ, গরিব, দুস্থ, প্রতিবন্ধী ও দিনমজুরদের বাদ দিয়ে কার্ডে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। যারা সচ্ছল, দলীয় বিবেচনায় তাদের কার্ড দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের পর নতুন কার্ড বিতরণ বন্ধ: নতুন তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারাও। ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সালমগীর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেন স্বপন গত ৮ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। এর আগে ২৫ জুন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছেও অভিযোগ করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, কিছু ব্যক্তিকে নিয়ে অনিয়ম করে সুবিধাভোগীর তালিকা করা হয়েছে; প্রকৃত দুস্থরা বঞ্চিত হয়েছেন। এ অভিযোগ পাওয়ার পরই কার্ড বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি সালমগীর হোসেন বলেন, আগের তালিকা বাদ দিয়ে নতুন করে তালিকা করা হয়েছে। সেখানে অনেক গরিব, দুস্থ, বিধবা ও প্রতিবন্ধী বাদ পড়েছেন। এটা মেনে নেওয়া যায় না। যারা কার্ড পাওয়ার যোগ্য, তাদেরই দিতে হবে। আমরা নতুন তালিকা বাতিলের দাবি জানাই। দলীয় কোন্দলেই জটিলতা: সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর স্থানীয় জামায়াত ও বিএনপির কয়েকজন নেতা টিসিবি কার্ড বাতিলের দাবি তোলেন। এ নিয়ে ৩ ডিসেম্বর সিটি করপোরেশনে বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গবেষণা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। আহ্বায়ক করা হয় নগর বিএনপির সাবেক সদস্য তাজ উদ্দিন সেন্টুকে, আর সদস্য করা হয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির মনিরুজ্জামান সেন্টুকে। পরে এ কমিটি নতুন তালিকা করে। এ প্রসঙ্গে নগর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানা অভিযোগ করেন, কিছু দলীয় নেতা আর সিটি করপোরেশনের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে পুরো তালিকাই স্বজনপ্রীতিতে ভরা। যারা কার্ড পাওয়ার যোগ্য, তারা পাননি। অথচ যাদের সামর্থ্য আছে, তারাই কার্ড পেয়েছেন। গরিব মানুষের জন্য যে কার্ড, তা গরিবরাই পাক। গবেষণা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান অবশ্য দায় এড়ানোর সুরে বলেন, ‘এটা আমি করছি না। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ঠিক নয়।’ কমিটির সদস্য জামায়াত নেতা মনিরুজ্জামান সেন্টু বলেন, ওয়ার্ডে কার্ড আছে আড়াই হাজারের মতো। সম্প্রতি অল্প কিছু কার্ড দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যেই অভিযোগ এসেছে, তাই বিতরণ বন্ধ আছে। আমরা প্রকৃত যোগ্যদের কার্ড দেব। কেউ বাদ পড়লে সেটাও নেওয়া হবে, আর যদি কোনো সচ্ছল ব্যক্তি থেকে থাকে, তাকেও বাদ দেব। তবে কমিটির আহ্বায়ক বিএনপি নেতা তাজ উদ্দিন সেন্টুর কণ্ঠে অভিমান, ‘আমাদের ঠিকমতো তালিকা করতে দেওয়া হচ্ছে না। আগের লোকজনই যদি থাকে, তাহলে আমাদের কমিটির কী দরকার? সেজন্য আমি আর কিছুই দেখছি না।’ রাসিকের ওয়ার্ড কার্যালয়ের সচিব শামসুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর আপাতত কার্ড বিতরণ বন্ধ করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানে। সমাধানের চেষ্টা চলছে। আমরাও চাই প্রকৃত দুস্থ ও গরিবরাই যেন কার্ড পান।