প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত, নতুন এসেছে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা

রোহিঙ্গা তরুণী উম্মে সলিমার (১৮) তাঁর মা সবুরা খাতুনকে নিয়ে কক্সবাজারে লেদা ক্যাম্পে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। মাস দুয়েক আগে মিয়ানমারের মংডুর আশিকখ্যাপাড়ার নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে তারা এসেছেন বাংলাদেশে। তাঁর খালা রমিজা খাতুন কয়েক বছর ধরেই লেদার আশ্রয় শিবিরে রয়েছেন। আরাকান আর্মির হাতে নিহত হয়েছেন সলিমার বাবা মো. হোসেন। এরপর নির্যাতন-অত্যাচার থেকে বাঁচতে সলিমা ও তাঁর মা এবং তিন ভাইবোন দালালের হাত ধরে যাত্রা শুরু করেন বাংলাদেশের উদ্দেশে। মিয়ানমারের মুদ্রায় ১০ লাখ টাকা রফিক নামে এক রোহিঙ্গা দালালকে দিয়ে পাড়ি দেন নাফ নদ। তবে নদ পাড়ি দেওয়ার আগেই মিয়ানমারের পথে ভাইবোনকে হারিয়ে ফেলেন। পরে অবশ্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তারা সেখানে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। মিয়ানমার থেকে সলিমার ভাই এনামুল হাসান (১৫) ও ইসমত আরা (১৩) মা ও বোনের কাছে ফিরতে মরিয়া। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে তারা নতুনভাবে দালাল ধরতে পারছে না। গতকাল রোববার কাছে নিজ পরিবার ও মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন হতভাগ্য তরুণী সলিমা। তিনি বলেন, ‘মগবাগি আর বাপরে মারি ফেইলে। জুলুমের জড়িয়া আর বিড়া বাড়িত ফেরত ন পারি। আর দুই ভাইবোনের জন্য চিন্তায় আছি।’ এখনও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দৃশ্যমান নয়। বছরের পরপর নানা ঝুঁকি ও সংকট মাথায় নিয়ে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে– এমন আলো দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। উল্টো প্রায় প্রতিদিন নতুন রোহিঙ্গা ঢুকছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ঢুকেছে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা। এরই মধ্যে তাদের আঙুলের ছাপ নিয়েছে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর)। এ নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়াল অন্তত ১৩ লাখ ২৪ হাজার। আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্তের ওপারে অপেক্ষমাণ; যারা বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া প্রতি বছর ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে আরও ৩০ হাজার শিশু। কক্সবাজারের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলছে রোহিঙ্গারা। বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে খুনোখুনি চলছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করছে। অনেক দিন ধরে মাদক চোরাচালানের আখড়ায় পরিণত হয়েছে ক্যাম্প। এদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বাজেট সহায়তাও ধীরে ধীরে কমছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আর্থিক সংকটে এনজিও পরিচালিত প্রায় ছয় হাজার ৪০০ অনানুষ্ঠানিক স্কুলে ক্লাস নেওয়া বন্ধ অথবা ক্লাসের সময় ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা হয়। এই পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তার মুখে চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশুর শিক্ষাজীবন। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশে। ওই বছরের ২৫ আগস্ট থেকে পরবর্তী কয়েক মাস অন্তত আট লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে তারা আশ্রয় নেয়। তাদের কয়েক হাজার আশ্রয় নিয়েছে ভাসানচরে। গতকাল শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, মংডুসহ কয়েকটি এলাকায় সম্প্রতি আরাকান আর্মির ওপর পাল্টা হামলা শুরু করেছে জান্তা সরকার। মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সদস্যরা এই হামলায় অংশ নিচ্ছে। তাই সেখানে যুদ্ধাবস্থা থাকায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঝুঁকি বাড়ছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সোয়া লাখের মতো রোহিঙ্গা এসেছে। তিনি আরও বলেন, সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে রোহিঙ্গা সম্মেলন আয়োজন করবে জাতিসংঘ। তার আগে রোববার থেকে কক্সবাজারে তিন দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন শুরু হয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের সমস্যার কথা শোনা হবে। এরপর সেটি জাতিসংঘ আয়োজিত সম্মেলনে তুলে ধরা হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পথরেখা তৈরি ও তাদের জন্য বাজেট সহায়তার ব্যাপারে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আর্কষণ অন্যতম উদ্দেশ্য। জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয় কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর শিক্ষা খাতে প্রয়োজন ৭২ মিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ১০ মিলিয়নেরও কম। রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীসহ মোট বাজেট চাহিদা ৯৩৪ মিলিয়ন ডলার হলেও ১২ জুলাই পর্যন্ত সংগ্রহ হয়েছে ৩০৩ মিলিয়ন ডলার। এটি প্রয়োজনীয় বাজেট সহায়তার ৩২ শতাংশ। তহবিলের এই ঘাটতি মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তায় ব্যাপকভাবে হ্রাস করার কারণে দেখা দিয়েছে, যা গত কয়েক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করে আসছে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) নেতা মো. জোবায়ের বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। তাই রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছে। আমরা এখনই ফিরতে চাই; কিন্তু কবে ফিরে যাব সেটা কেউ জানে না। খবর পাচ্ছি জান্তা সরকার নতুনভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যাতে আরাকান আর্মির দখলে থাকা মংডু-বুথেডং টাউনশিপ উদ্ধার করতে পারে। আকিয়াবে (সিতওয়ে) এখনও আইপিডি ক্যাম্পসহ দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসতি রয়েছে। সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, বেশ কিছুদিন ধরে মিয়ানমারকেন্দ্রিক সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা), আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান রোহিঙ্গা আর্মিসহ (আরআইআর) কয়েকটি গোষ্ঠী। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা মংডু টাউনশিপের কাছাকাছি নাফ নদের তীরে অবস্থান করছে। নাফ অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা টেকনাফ অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটকও হচ্ছে। বিজিবির ভাষ্য, বেশ কিছুদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য সীমান্তের দুই পাশে একটি চক্র রয়েছে, যারা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসছে। এই বাণিজ্যের সঙ্গে আরাকান আর্মির সদস্য ছাড়াও রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ জড়িত। কক্সবাজারের টেকনাফের ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকের মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) মো. নুর। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেও এখনও তার পরিবারের ৯ সদস্য রাখাইনে অবস্থান করছেন। তিনি জানান, রাখাইনে আরাকান আর্মি নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের বাংলাদেশে আনতে হলে দালালদের অর্থ দেওয়া লাগবে। আবার আরাকান আর্মিকে অর্থ না দিলে সীমান্ত অতিক্রম করা যায় না। হাতে টাকা না থাকায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে খুব চিন্তিত আছি। ঘরে থাকা তেল-মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। যারা তেল-মরিচ দিতে পারছে না, সেসব রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেককে ধরে আরাকান আর্মি জেলে ভরছে। আট বছর আগে মংডুর কাওয়ারবিল থেকে তিন সন্তানসহ আমেনা বেগম পালিয়ে আসেন কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে। চলতি বছরের শুরুতে তিন সন্তান নিয়ে উন্নত জীবনের আশায় একটি রোহিঙ্গা দলের সঙ্গে সাগরপথে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন মালয়েশিয়ায়। প্রায় দুই মাস সাগরে দুর্বিষহ দিন কাটানোর পর আবারও ফিরতে হয়ে কক্সবাজারে। আমেনা বলেন, নিজ দেশে ফিরতে চাই। ভিটেমাটি ফেলে এসে অন্য দেশ কতকাল থাকব। বিজিবি বলছে, গেল আট মাসে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে নাফ নদসহ সংলগ্ন এলাকা থেকে অন্তত ২৪০ জেলেকে অপহরণ করে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে চলতি বছরের মার্চ থেকে ২৩ আগস্ট মাস পর্যন্ত অপহৃত হন ১৮০ জন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সহায়তায় এদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে কয়েক দফায় ফেরত আনা হয়। সর্বশেষ শনিবার সাগরে মাছ শিকার শেষে ফেরার পথে নৌকাসহ ১২ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। রোববার আরও ১৪ জন জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া ক্যাম্পে গত আট বছরে অন্তত ৩০০ জন খুন হয়েছে; মামলা হয়েছে ২৮৭টি। জেলা পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের আট মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ১০ ধরনের অপরাধের বিপরীতে মামলা হয়েছে ২৫০টি। যেখানে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৮টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মাদক ও অপহরণ-সংশ্লিষ্ট। মাদকের মামলা ১৫০, অপহরণের ৫০ ও ধর্ষণের মামলা হয়েছে ১২টি। এদিকে ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান-জেআরপি’ কর্মসূচির আওতায় কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে প্রতিবছর প্রতিশ্রুত বরাদ্দ কমছে। এমন বাস্তবতায় নতুনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের জন্য নতুন চাপ সৃষ্টি করছে। ২০২৪ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৯০০ মিলিয়ন চেয়ে পাওয়া গেছে ৬০০ মিলিয়ন। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের জন্য ৮৭ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা চেয়ে মিলেছে এর অর্ধেক। চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল তার মধ্য থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে এক হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাদের মধ্যে ৭১১ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, আট বছরে একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। উল্টো অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।