বেসিক ব্যাংকের সব সূচক নিম্নমুখী

সরকারি-বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে বেসিক ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সবল ছিল। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে লুটপাটের কবলে পড়ে দুর্বলের খাতায় নাম লিখিয়েছে ব্যাংকটি। লুটপাটের অন্যতম হোতা সাবেক সংসদ-সদস্য আবদুল হাই বাচ্চু। তাকে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে চেয়াম্যান করা হয়। এরপর থেকে ২০১২ সালের মধ্যেই ব্যাংকটি লুটপাট করে ‘ফোকলা’ বানানো হয়। ঋণের নামে ব্যাংকটির আমানতকারীদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। এলসির নামে ঋণের একটি অংশ পাচার হয়েছে বিভিন্ন দেশে। লুট ও পাচারের টাকা সবই খেলাপি হয়েছে। খেলাপি ঋণ লাফিয়ে বেড়ে এখন ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ব্যাংকটির শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছেই আটকে আছে ৫ হাজার কোটি টাকা। প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি বেড়ে রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। পুঞ্জীভূত লোকসান বেড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারে সরকার থেকে অপরিকল্পিতভাবে এখন পর্যন্ত মূলধন বাবদ জোগান দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এরপরও ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে গত বছরের মে মাসে ব্যাংকটিকে বেসরকারি খাতের একটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর প্রভাবে ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আমানত তুলে নেয়। ফলে এটি আরও সংকটে পড়ে। এখন ব্যাংকটির সব সূচকে অবনতি ঘটছে। আমানত, ঋণ, আয়-সবই কমছে। বাড়ছে খেলাপি ঋণ, মূলধন ও প্রভিশন ঘাটতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ আমানত জমায়ও ঘাটতি বেড়েছে। সব মিলে একসময়ের সবল ব্যাংকটিকে এখন ব্যাংক খাতের ‘বিষফোড়া’ হিসাবে দেখা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বস্তায় ভরে ব্যাংকের শান্তিনগর ও গুলশান থেকে ঋণের নামে রাতের আঁধারে টাকা বের করা হয়েছে। যিনি ১০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার যোগ্য, তাকে দেওয়া হয়েছে শতকোটি টাকা। ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত নেওয়া হয়নি। যেসব জামানত নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ভুয়া ও অতি মূল্যায়িত। যে কারণে লুটের পর ব্যাংক বন্ধকি জামানত বিক্রি করে ঋণ আদায় করতে পারেনি। অনেক ঋণগ্রহীতার হদিস মেলেনি। ঋণ নিয়ে এলসি খুলে ১৭৫ কোটি টাকার পণ্য দেশে আনা হয়নি। এসব টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আরও টাকা পাচার হয়েছে। সব মিলে ব্যাংকের আমানতকারীদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা লুট করা হয়েছে। লুটের টাকার বড় অংশই পেয়েছেন বাচ্চু, তার পরিবার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। তারা সবাই এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ব্যাংক লুটের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বাচ্চুকে সরাসরি দায়ী করলেও সরকার থেকে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০১৫ সাল থেকে মামলা হলেও বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। ২০২৩ সালে এসে প্রথম বাচ্চুকে আসামি করা হয়। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। ফলে তিনি দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান। এখন সপরিবারে লুটের টাকায় বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন। সূত্র জানায়, ক্ষুদ্র শিল্পে ঋণ দেওয়ার জন্য সরকারি উদ্যোগে বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৯৮৯ সালে। সরকারের পক্ষে ব্যাংকটির মূল দায়িত্ব পালন করত শিল্প মন্ত্রণালয়। শুরু থেকে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন পদাধিকারবলে শিল্পসচিব। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারা এর পর্ষদের সদস্য থাকতেন। ফলে ব্যাংকটি খুব সুনামের সঙ্গেই চলছিল। আর্থিক সূচকেও সরকারি-বেসরকারি সব ব্যাংকের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল। খেলাপি ছিল ৩ শতাংশের নিচে। প্রতিবছর মুনাফা থেকে প্রভিশন, রিজার্ভ তহবিল বৃদ্ধি করে সরকারকে ৫০ কোটি থেকে ৭০ কোটি টাকা মুনাফা দিত। এমন একটি শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাংককে ‘রাজনৈতিক পুরস্কার’ হিসাবে ব্যাংকিংয়ে একেবারেই অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তি সাবেক সংসদ-সদস্য আবদুল হাই বাচ্চুকে পর্ষদের চেয়ারম্যান বানিয়ে লুটপাটের পথ করে দেওয়া হয়। এ সুযোগে নিজের, পরিবারের সদস্য ও সাঙ্গোপাঙ্গরা বনে যান কোটিপতি। দেশে-বিদেশে গড়ে তোলেন বিলাসবহুল সম্পদ। চেয়ারম্যান হিসাবে যোগদানের পর থেকেই নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে নিজের পছন্দমতো লোক নিয়োগ দিতে থাকেন। ওই বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকের নিজস্ব ভবন নির্মাণে জমি কেনার জন্য ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করেন। মতিঝিলেই ঝামেলাপূর্ণ একটি জমি কেনেন। শতকোটি টাকা খরচ করে একটি ভবন করেন। কিন্তু তার দখল এখনো বুঝে পায়নি ব্যাংক। সেটি দিয়েই আর্থিক দুর্নীতি শুরু। এরপর থেকে একের পর এক ঋণ বিতরণের নামে চলে লুটপাট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ২০২০ সালের আগে কখনো ব্যাংকটির আর্থিক অবস্থার উন্নতি হলেও তা টেকসই হয়নি। এখন উলটো অবনতি হচ্ছে। ২০২০ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৫২ শতাংশ। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৬৯ শতাংশ। গত মার্চে এসে খেলাপি সামান্য কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের সাড়ে ৬৯ শতাংশ। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৮ হাজার ৫০৯ কোটি টাকাই আদায় অযোগ্য কুঋণে পরিণত হয়েছে, যা মোট খেলাপির প্রায় সোয়া ৬৮ শতাংশ। ব্যাংকটির কুঋণ থেকেও আদায় বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে বেশকিছু ঋণ আদায় করা হয়েছে। আরও কিছু ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়ায় আছে। ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশন রাখা দরকার ৫ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে রাখা আছে মাত্র ৫৩৭ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি ৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ ও প্রভিশন ঘাটতি বাড়ায় ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে মূলধন ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে মূলধন ঘাটতি ছিল ৯৪২ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতিবছরই মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। মাঝেমধ্যে মূলধন ঘাটতি কিছুটা কমলেও তা স্থায়ী হচ্ছে না। কারণ, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংকের আয় কমায় প্রভিশন আনুপাতিক হারে বাড়ানো যাচ্ছে না। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক ১ হাজার ৩৬২ কোটি টাকার সুদ আয় খাতে নিতে পারছে না। ঋণ আদায় হলে এসব সুদও আয় খাতে নিতে পারত। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। সার্বিকভাবে ব্যাংকটির সম্পদের পরিমাণও কমছে। ২০২০ সালে সম্পদ ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকায়। ২০২০ সালে ব্যাংকের আমানত ছিল ১৩ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা, ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। গত বছর তা আবার কমে হয় ১৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকায়, যা ২০২০ সালের চেয়ে কম। নতুন ঋণ বিতরণ কম হওয়ায় এর স্থিতিও কমে যাচ্ছে। ২০২০ সালে ঋণের স্থিতি ছিল প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। গত বছর তা কমে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। কিছু ঋণ আদায় ও অবলোপনের কারণে ঋণ স্থিতি কমেছে। প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ঋণ আমানতের অনুপাত এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০২০ সালে ছিল ১০০ শতাংশ। গত বছর তা কমে সাড়ে ৯৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ব্যাংকগুলো মোট আমানতের ৮৩ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারে। এর বেশি হলে ঝুঁকি বাড়ে। বেসিক ব্যাংকের আমানত কম হওয়ার পরও তারা বাড়তি ঋণ দিয়েছে। ব্যাংকটির ২০২০ সালে লোকসান ছিল ৩৭২ কোটি টাকা। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬৩ কোটি টাকায়। এখন পর্যন্ত পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকের সম্পদ থেকে আয়ে ২০২০ সালে ঘাটতি ছিল ১ দশমিক ৯০ শতাংশ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ থেকেও আয় না হয়ে লোকসান হচ্ছে। শেয়ারের দাম কমার কারণে এমনটি হচ্ছে। ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির তালিকায় এখনো আগের নামগুলোই আছে। তাদের কাছ থেকে ঋণ আদায় হচ্ছে না বলেই চলে। কারণ, এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বাচ্চুর বেনামি প্রতিষ্ঠান। যে কারণে এদের কারও অস্তিত্ব মিলছে না। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রেখে এখন পর্যন্ত শীর্ষ খেলাপিদের ৫০০ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করেছে। এদিকে গত বছরের মে মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেসিক ব্যাংককে বেসরকারি সিটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর গ্রাহকরা প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। এতে ব্যাংকটি আরও সংকটে পড়ে, যা এখনো মোকাবিলা করতে হচ্ছে।