ধানমন্ডি ৩২: নিরাপত্তার মধ্যে শোক জানাতে গিয়ে মারধর-হেনস্তার শিকার

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে যাওয়া কয়েকজনকে শুক্রবার ধাওয়া দিয়েছে একদল জনতা। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রিকশাচালকসহ দুজন মারধরের শিকার হন। ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার থেকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ। ৩২ নম্বরের দুই প্রবেশমুখে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে রাখা হয়। প্রস্তুত রাখা হয় সাঁজোয়া যান ও জলকামান। বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সেখানে ডিজিটাল ডিসপ্লেতে '৩৬ জুলাই'য়ের (৫ আগস্ট) ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। পাশাপাশি সাউন্ডবক্সে জুলাই, দেশাত্মবোধক ও হিন্দি গান বাজানো হয়। এছাড়া মেজর শরিফুল হক ডালিমের ১৯৭৫ সালের ভাষণ প্রচার করা হয় ডিজিটাল ডিসপ্লেতে। ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী আয়োজনে সংশ্লিষ্ট দুই তরুণের সঙ্গে শুক্রবার কথা বলে । তারা নিজেদের নাম বলতে রাজী হননি। তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তাদের বাসা ধানমন্ডিতে। ধানমন্ডিবাসী এই '৩৬ জুলাই' ডকুমেন্টারি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বলে তারা দাবি করেন। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার ১০-১২ জন শোক জানাতে এসেছিলেন ধানমন্ডি ৩২ এ। এর মধ্যে সন্দেহভাজন সাতজনকে ধানমন্ডিতে প্রবেশপথে আটক করে পুলিশ। তবে ৫ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার জিসানুল হক বলেন, ‘ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।’ ৩২ নম্বরের এই বাড়িটিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অতর্কিত হামলা চালিয়ে পরিবারের ১৮ জন সদস্যসহ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতকরা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। দিনটি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করা হতো। তবে ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ১৫ আগস্ট শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বাতিল করে। সে হিসেবে দুই বছর আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে শুক্রবার পুরোপুরি আলাদা এক দৃশ্য ছিল ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে পুলিশ। এদিন রাত ১০টার পর সেখানে গিয়ে দেখা যায়- যুবদল এবং ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা জমায়েত হয়ে বিএনপির পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগবিরোধী স্লোগানও দিতে দেখা যায়। শুক্রবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম শাহাদাতবার্ষিকীতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে তার বাড়ির সামনে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে মারধর ও হেনস্তার শিকার হয়েছেন রিকশা চালক আজিজুর রহমান। তিনি দুপুর সোয়া ১২টায় রিকশা চালিয়ে ৩২ নম্বরে আসেন। রিকশাটি রাস্তার পাশে পার্কিং করে ফুল নিয়ে ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়ান। ফুলের তোড়ার ওপর কাগজে লেখা ছিল– '১৫ই আগস্ট জাতীয় শোক দিবস’। হাতে ফুল দেখে গণমাধ্যমকর্মী এবং ইউটিউবাররা তাকে ঘিরে ধরে ফুল নিয়ে আসার কারণ এবং তার রাজনৈতিক পরিচয় জানার চেষ্টা করেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। এ সময় কয়েকজন তাকে মারধর শুরু করেন। নিজেকে রিকশাচালক পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, তার বাসা বাসাবো এলাকায়। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। তিন বছর ধরে তিনি ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে শাহবাগ থেকে চারশ টাকায় ফুলের তোড়া কিনে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। কথা বলার মধ্যেই ৫-৬ জন যুবক তাকে পান্থপথের দিকে মারতে মারতে নিয়ে যান। অবশ্য কয়েকজন ঠেকানোর চেষ্টা করেন। পরে তাকে আবার ৩২-এ এনে মারধর করা হয়। পরে ধাওয়া দিলে তিনি চলে যান। এর আগে সকালে ফুল নিয়ে আয়েশা নামের এক নারী ৩২ নম্বরে আসেন। তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের কর্মী দাবি করে ৩২-এ ফুল দেবেন বলে জানান। এ সময় কয়েকজন যুবক তাকে ধাওয়া দিলে তিনি একটি রিকশায় চড়ে চলে যান। এ ছাড়া আরও এক নারী সেখানে আসলে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। লোকজন তাকে চলে যেতে বললে সবার সঙ্গে তর্কে জড়ান। সেখানে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এখানে দালালি করতে আসিনি। আমি কোনো দল করি না। আমি বসুন্ধরা সিটিতে যাবো। এ সময় আশেপাশের লোকজন তাকে চলে যেতে বললে এক পর্যায়ে তিনি রিকশায় উঠে চলে যান। এছাড়া স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে এক ব্যক্তি আসেন ৩২ নম্বরে। তিনি আসলে উপস্থিত জনতার তোপের মুখে পড়েন। তখন তিনি শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। উপস্থিত লোকজন জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশের মানুষ মেরেছেন– এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, হাসিনা মারেননি। তার চাটুকাররা মানুষ মেরেছে। একইভাবে শ্রদ্ধা জানাতে তোপের মুখে পড়েন আরও এক দম্পতি। এদিকে দুপুরে ভাইরাল হতে এসে ধাওয়া খান বঙ্গবন্ধুর বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় উল্লাস করা সেই ‘ভাইরাল সিদ্দিক’। তিনি ধানমন্ডি ৩২-এ ফুল দিতে আসেন। তিনি কখনও নিজেকে আওয়ামী লীগ, কখনও এনসিপি আবার কখনও বিএনপির ওলামা দলের নেতা বলে দাবি করে ভাইরাল হয়েছেন। তাকে গত বছর ধানমন্ডি-৩২ এ শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙতে দেখা গেছে। সর্বশেষ শুক্রবার সেখানেই শ্রদ্ধা জানাতে গেলে মারধরের শিকার হন তিনি। বিকেলে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক আওয়ামী লীগ কর্মী শ্রদ্ধা জানাতে এলে জনরোষের মুখে বাসে উঠে এলাকা ত্যাগ করেন। ধানমন্ডি থানার ওসি কাশৈন্যু মারমা বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে ৩২ নম্বরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। সেখানে যাতে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড না হয় সেজন্য তিন প্লাটুন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়। তিনি বলেন, সন্দেহজনকভাবে সাতজনকে আটক করা হয়েছিল। যাচাই বাছাই করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা না থাকায় ৫ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ২ জন হেফাজতে রয়েছে।