গাজায় যেন ‘স্কুইড গেম’র মৃত্যুখেলা খেলছে ইসরাইল!

গাজার ছোট্ট শিশু আহমেদ জিদান। চোখ দুটো লাল। হাত-পা সব কাঁপছে। ধুলোমাখা শরীরে ছলছল চোখে মাটিতে বসে আছে সে। সামনেই তার মায়ের নিথর দেহ। ভোরে ছেলের জন্য একটু খাবারের উদ্দেশ্যে গিয়েছিল জিদানের মা। কিন্তু ত্রাণের বদলে লাশ হয়ে ফিরতে হলো তাকে। এ যেন জনপ্রিয় কোরিয়ান ওয়েবসিরিজ স্কুইড গেমের বাস্তবচিত্র। ‘স্কুইড গেমে’ যেমন টাকার জন্য প্রতিযোগিতা হয়; তেমনি গাজায় সেই প্রতিযোগিতা খাবারের জন্য। আর একটু ভুল হলেই ইসরাইলি স্নাইপারের গুলিতে নিশ্চিত মৃত্যু। কোনো সতর্র্কবার্তা ছাড়াই প্রাণ হারাতে হবে যে কোনো সময়। যেমনটি হয় স্কুইড গেমে। পার্থক্য শুধু-‘স্কুইড গেম’-এ নাম লেখানোর আগেই শর্তগুলো জানানো হয়। আর ইসরাইলের ‘ত্রাণ গেম’-এ অংশগ্রহণকারীর পরিণতি অলিখিত! এপি। সংগত কারণেই গাজাকে ‘স্কুইড গেমের’ সঙ্গে তুলনা করছে অনেকে। কেননা সিরিজটির মতো এই মৃত্যু উপত্যকা থেকে বেরোনোর কোনো পথ নেই। সিরিজটির প্রথমে দেখানো ‘রেড লাইট, গ্রিন লাইট’ গেইমটির মতো হয়তো এখানে কোনো সেন্সর বসানো পুতুল নেই। কিন্তু ইসরাইলি গুলি যে কোনো দিক থেকে এসে বাসিন্দাদের মেরে ফেলতে পারে। ২৭ মে থেকে অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে শুরু হয়েছে ত্রাণ বিতরণের নামে ইসরাইল সমর্থিত মার্কিন প্রতিষ্ঠান গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) এই ‘স্টিসেমেটিক কিলিং’ সিরিজ। যেখানে অলিখিত একটি সময়ের মধ্যে ত্রাণ নিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারলেই মরতে হবে ইসরাইলের হাতে। তখন শুধু গাজার সীমান্তবর্তী অঞ্চল রাফাতে একটি বিতরণ কেন্দ্র খোলা হয়। ১৭ জুন মধ্যরাতে জিএইচএফ ঘোষণা করে খান ইউনিসে তাদের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রটি সকাল ৬টায় খুলবে। ততদিনে (গত ২০ দিনে) গাজার তারেক আল-বোরাইম বুঝে গিয়েছিলেন কিভাবে কাজ করছে জিএইচএফ। হাতের কাছের মানুষদের সতর্ক করছিলেন, ‘কেউ বিতরণ কেন্দ্রের কাছে যাবেন না বা খোলার আগে গেটে জড়ো হবেন না। তিনি সতর্ক করেছিলেন-কেন্দ্রটি তাদের ঘোষিত সময়ের আগেই সাহায্য বিতরণ শুরু করবে এবং কিছুক্ষণ পরেই এর গেট বন্ধ করে দেবে। ত্রাণ নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সরে পড়াও বিপজ্জনক। যে কোনো মুহূর্তে গুলি চালাতে পারে ইসরাইলি বাহিনী। কিন্তু বিকল্পই বা কি? হয় ত্রাণ কেন্দ্রের গুলিতে মরো না হয় ক্ষুধায়! সব জেনেবুঝেও দ্বিতীয় কোনো পথ তাদের সামনে নেই। সুতরাং বাধ্য হয়েই প্রতিদিন এই ভয়ংকর মৃত্যুখেলা খেলতে হচ্ছে অসহায় গাজাবাসীদের।’ দিন শেষে বোরাইমের ভবিষ্যৎ বাণীই সেদিন সঠিক প্রমাণিত হয়। ঘোষিত সময়ের ৪ ঘণ্টা আগেই (রাত ১টা ৪৭ মিনিটি) ত্রাণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কিছুক্ষণ পরেই গেট বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিরা তখনো একটু খাবারের আশায় জড়ো হতে থাকে। শুধুমাত্র সেদিনই, সাহায্যের জন্য অপেক্ষারত কমপক্ষে ৫৯ জন ফিলিস্তিনি ইসরাইলের হাতে নিহত হয়েছিল। স্কুইড গেমের ‘রেড লাইট গ্রিন লাইট’ পর্বটিতেও নির্দিষ্ট সময়ের পরে পৌঁছালেই স্নাইপারের গুলিতে মেরে ফেলা হতো প্রতিযোগিদের। গাজার সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, মে মাসের শেষের দিকে জিএইচএফ কার্যক্রম শুরু করার পর থেকে, ত্রাণ সংগ্রহের প্রতিদিনের এই খেলায় ৫৮৪ জন ত্রাণপ্রার্থী নিহত এবং ৪,০০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে। বেইত লাহিয়ার সামেহ এখন আশ্রয়হীন হয়ে আল-শাতি শরণার্থী শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। গভীর ক্লান্তি ও আতঙ্কের সুরে সামেহ বলেন, ‘শত দিনের বেশি আমরা না খাইয়ে আছি। তারা (ইসরাইল) একটুকু খাবার ঢুকতে দেয়নি। তারপর খুলল তথাকথিত আমেরিকান সাহায্য কেন্দ্র যা ইসরাইলি সৈন্যদের পাহারায় পরিচালিত হচ্ছে। এটা খাবার নয়, এটা ফাঁদ।’ গাজার আরেক বাসিন্দা ওয়াদি। খাবারের সন্ধানে গিয়েছিলেন তিনি। নেটজারিমের কাছে খাবার আনতে গিয়ে তিনি দেখলেন খেলাঘরের মতো একটি জায়গা। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া, ভেতরে সহায়তা সামগ্রী। গেট খুলবে কখন, কেউ জানে না। সকাল বা রাতের কোনো ঠিক নেই। ওয়াদি বলেন, ‘এমনও হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার মানুষ একসঙ্গে গরমে অপেক্ষা করে। গেট খোলার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে ভেতরে ঢুকে, কাঁটাতার ডিঙিয়ে, এক মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যায়।’ এই লাইনে দাঁড়িয়ে সামেহ শুধু ক্ষুধা নয়, মৃত্যু দেখেছেন।তিনি বিশ্বাস করেন-ইসরাইল বিশৃঙ্খলা চাইছে। সামেহ বলেন, ‘তারা আতঙ্ক চায়। এই কেন্দ্রগুলো শুধু দেখানোর জন্য যেন গাজায় সাহায্য আসছে। কিন্তু কী উপকার, যদি সেই সাহায্য আমরা পৌঁছাতে না পারি? যদি জীবন বাজি রেখে শুধু এক ব্যাগ ময়দা পেতে হয়? এটা কেমন সাহায্য?’ রোববার ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী-অবরুদ্ধ গাজায় শুধুমাত্র ত্রাণ আনতে গিয়ে ১,৬৫৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ১১,৮০০। স্কুইড গেমের আরও একটি বিষয় গাজার বাস্তবতাকে তুলে ধরে। স্কুইড গেমে প্রতিযোগিদের মৃত্যু টাকা দিয়ে উপভোগ করত কিছু ধনীগোষ্ঠী। মনোরঞ্জনের জন্য সাধারণ মানুষের নৃশংস মৃত্যুতে তারা হাসি-তামাশা করত। অবরুদ্ধ গাজার দৃশ্যপটও ঠিক এমনই। ইসরাইলকে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এবং নিজেদের স্বার্থের জন্যে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র গাজার মৃত্যুমিছিল উপভোগ করছে।