রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, তরুণরা কেন বেশি বিশ্বাস করে

জাতীয় নাগরিক পার্টির কয়েক নেতা-নেত্রী কক্সবাজার ভ্রমণে যান জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিন- ৫ আগস্ট। ওইদিনই সকালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অনেক ব্যবহারকারী পোস্ট দেন, ‘সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করতে কক্সবাজারে গেছেন এনসিপির কয়েক নেতা’। পরে এ ধরনের খবরকে গুজব উল্লেখ করে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এর একদিন আগে ৪ আগস্ট রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন চত্বরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, দেশে যেন গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঠিকমতো না হয়, সে জন্য আবার অস্থিরতা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চলছে। ৭ আগস্ট বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘শেখ হাসিনার পতনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ’। এতে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতা হারানোর এক বছর পরও আওয়ামী লীগ তাদের সরকারের পতনের ঘটনাকে ‘‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে।’ বিভিন্ন বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের ষড়যন্ত্র খুঁজে পাওয়ার প্রবণতা বহুল চর্চিত। একটি জরিপে দেখা গেছে রাজনৈতিক মহলে চাউর হওয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসকারীদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ-তরুণী। শুধু যে দলীয় রাজনৈতিক পর্যায়েই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে বেশি আলোচনা হয় বিষয়টা এমন নয়। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়ও এর জন্য চীনকে দায়ী করে নানা আলোচনা চাউর হয়েছিল। কেউ কেউ ওষুধ শিল্প মালিকদের বিরুদ্ধেও ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। একটি জরিপের বরাত দিয়ে মার্কিন গণমাধ্যম সিবিসি ৫ আগস্ট জানিয়েছে, যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে তাদের মধ্যে ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসের প্রবণতা বেশি। জরিপটি পরিচালনা করেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার রাজনীতি অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড্যানিয়েল স্টোকেমার। জরিপে বিভিন্ন দেশের ৩ লাখ ৮০ হাজার মানুষ অংশ নেয়। ষড়যন্ত্রে বিশ্বাসের কারণ ড্যানিয়েল স্টোকেমার বলছেন, ১৮ বছর বয়সী এক তরুণের তুলনায় ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করার সম্ভাবনা ১০ শতাংশ কম। ষড়যন্ত্রে তরুণ-তরুণীদের সংবেদনশীল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এখন অনেক বেশি বিভক্ত ও অরাজক হয়ে উঠেছে। এরপরেই আছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম। যেখানে ভুল তথ্য ষড়যন্ত্র আকারে বেশি ছড়ায়। ভ্রান্ত তথ্য, চরমপন্থা ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন কানাডার ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কারমেন সেলেস্টিনি। তাঁর মতে, ভয় ও ক্রমাগত অরাজকতার অনুভূতি মানুষকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। এ ছাড়া, যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করেন তারা সাধারণ মানুষকে অন্য কারও ওপর দোষ চাপানোর সুযোগ তৈরি করে দেন। যখন বিশ্বাস বাড়ে ‘শেখ হাসিনার পতনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে আওয়ামী লীগ’ শিরোনামে বিবিসি বাংলা যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্বের দাবি নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সক্রিয় দলগুলো এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠন বিতর্কে জড়িয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। তাদের পাল্টাপাল্টি দাবি এক ধরনের বিভক্তিও তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিটাকে আওয়ামী লীগ তাদের ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।’ অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড্যানিয়েল স্টোকেমার তাঁর জরিপের বরাত দিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্র কাজ করছে না-এমন অনুভূতি থেকে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। এ ধরনের প্রেক্ষাপট ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের উর্বর ভূমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, নিরাপত্তাহীনতা মানুষের দুর্বল চিত্তের প্রকাশ ঘটায়। যেটা থেকেও অনেকে ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করে। সাব্বির আহমেদ বলেন, অনেক সময় রাজনীতিবিদরা কিছু ‘পলিটিক্যাল লাই’ বা রাজনৈতিক মিথ্যাচার প্রচার করেন। আদতে ভিত্তিহীন হলেও তারা অনেক কিছুতে ষড়যন্ত্র দেখতে পাচ্ছেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এগুলো আসলে জনমত নিজেদের পক্ষে নেওয়ার একটি কৌশল।