ডেঙ্গুতে টালমাটাল চট্টগ্রাম

৯ আগস্ট, ২০২৫ | ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি মাসে আগের মাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। নগরীর সঙ্গে উপজেলাগুলোতেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে সমানতালে। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে চলতি মাসের আট দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ১৩১ জন, মারা গেছেন চারজন, যা অন্যান্য মাসের একক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। ডেঙ্গু পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাওয়ায় জনমনে বাড়ছে আতঙ্ক ও উদ্বেগ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে আগস্টের প্রথম আট দিনে মোট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৬ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১৩ জন। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ৬৭ জন। শহর-গ্রামে আক্রান্ত সমানে সমান : চট্টগ্রামে নগরীর চেয়ে গ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। আক্রান্তদের মধ্যে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের রোগী ৪৭৮ জন, আর ১৫টি উপজেলায় রোগী ৫২৮ জন। গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুণ্ড উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১৫২ জন। আর সবচেয়ে কম সন্দ্বীপ ও বোয়ালখালী উপজেলায়। এ দুই উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা সাতজন করে। বাকি উপজেলাগুলোর মধ্যে বাঁশখালীতে ১৩০ জন, লোহাগাড়ায় ৪৪, সাতকানিয়ায় ৩৫, আনোয়ারায় ৪১, চন্দনাইশে ১১, রাঙ্গুনিয়ায় ৮, রাউজানে ২৮, ফটিকছড়িতে ৮, হাটহাজারীতে ১৬, মিরসরাইয়ে ১২ ও কর্ণফুলী উপজেলায় ১৬ জন। আক্রান্তের হার মে মাস থেকে ঊর্ধ্বমুখী : চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে আক্রান্তের হার কিছুটা বেশি হলেও পরের তিন মাস ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলে অনেকটা কম ছিল। তবে মে থেকে আক্রান্তের হার বাড়তে শুরু করে, যা দিন দিন আগের মাসকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারিতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৭০ জন। পরের তিন মাসে যথাক্রমে ফেব্রুয়ারিতে ২৮, মার্চে ২২, এপ্রিলে ৩৩ জনে নেমে আসে। তবে মে মাসে ১১৬ জন, জুনে ১৭৬, জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৪৩০ ও আগস্টের ৮ দিনে ১৩১ জন আক্রান্ত হন। ২১৮ দিনে ১৩ মৃত্যু, ৮ দিনেই ৪ : চট্টগ্রামে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে একজন, এপ্রিলে এক, জুলাইয়ে সাত ও আগস্টের প্রথম ৮ দিনেই চারজন মারা গেছেন। মশার লার্ভা এক বছরে বেড়ে দ্বিগুণ : চলতি জুলাই মাসে প্রকাশিত রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) জরিপ বলছে, চট্টগ্রামে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বা ব্রুটো ইনডেক্স এক বছরে দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ২৯ শতাংশে। গত বছর এই হার ছিল ৩৬ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০ শতাংশের বেশি হলেই সে এলাকাকে মশাবাহিত রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে উঠে এসেছে আগ্রাবাদ, যেখানে এই সূচক ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত। মশা মারতে নেই তোড়জোড় : ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকলেও মশা মারতে নগর কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসনের তেমন তোড়জোড় নেই বলে অভিযোগ জনসাধারণের। নগরীর ১২নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, আমাদের এদিকে এক মাসেও মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। সিটি করপোরেশনের লোকজনও আসছে না। ২৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফরহাদ আলমও বলেন একই কথা। গত এক মাসে তিনিও ওষুধ ছিটাতে দেখেননি। একই অবস্থা বিভিন্ন উপজেলায়ও। সীতাকুণ্ডের ছলিমপুর এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, সীতাকুণ্ডে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। এখানে মশার ওষুধ ছিটাতেও দেখেননি কখনো। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আমরা বিষয়টি জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চিঠিও দিয়েছি। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম বলেন, আমরা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি। উপজেলা প্রশাসনকেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদারকি করব। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা ১০০ দিনের বিশেষ ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা কম আছে। মশার ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি লিফলেট বিতরণ ও মাইকিং করা হচ্ছে। এ ছাড়া অসচেতন বাড়ির মালিকদের ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জরিমানার আওতায়ও আনা হচ্ছে। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট (মেডিসিন) ডা. এ এস এম লুৎফুল কবির শিমুল বলেন, ডেঙ্গু থেকে রেহাই পেতে এডিস মশা মারার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সার্বক্ষণিক সচেতন থাকতে হবে। মশারি টানানোর পাশাপাশি বড় জামা পরিধান করা উচিত। এডিস মশা যেসব জায়গায় জন্মায়, সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। সর্বোপরি জ্বর হলে আতঙ্কিত না হয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।