রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়েছে ১২৩ চাঁদাবাজের তালিকা, বিএনপি-জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতা যুক্ত

রাজশাহী মহানগর বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের ১২৩ জন চাঁদাবাজের নাম সংবলিত একটি তালিকা রাজশাহীর রাজনৈতিক অঙ্গনে গত কয়েকদিন থেকে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। তালিকায় বিএনপি, ছাত্রদল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, ক্যাডার, সমর্থক থেকে শুরু করে ৪৪ জনের নাম-পরিচয় আছে। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর ৬ জনের নাম আছে। এদের মধ্যে যাদের রাজনৈতিক পরিচয় নেই যাদের, তাদের সুবিধাবাদী বলা হয়েছে। তবে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তালিকাটিতে যাদের রাজনৈতিক পরিচয় উহ্য রাখা হয়েছে, তারা এনসিপিসহ অন্তর্বর্তী সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন প্রভাবশালী লোকজন। কোনো বিশেষ কারণে তাদের দল-সংশ্লিষ্টতা আড়াল করা হয়েছে। নগরীর একজন প্রবীণ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যারা চাঁদাবাজি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে সুবিধা আদায় করে, তারা কোনো না কোনো রাজনৈতিক ছাতার নিচে সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি। রাজনৈতিক ছত্রছায়া না থাকলে কেউ এসব কাজে জড়িত থাকতে পারে না। আবার কেউ কেউ দাবি করছেন, আওয়ামী লীগের লোকজনই এই তালিকা করে চাঁদাবাজদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে। যদিও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট কেউ। তালিকার ১৮ জনের নাম সম্প্রতি একজন আবাসন ব্যবসায়ীর দায়ের করা চাঁদাবাজির মামলায় আছে। সেই মামলায় ছাত্রদল ও যুবদলের নেতাদের প্রধান আসামি করা হয়েছে। এই মামলার প্রতিবাদে তারা সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছে। এই তালিকা পুলিশের নাকি সরকারের অন্য কোনো সংস্থার তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বিএনপির সংবাদ সম্মেলনে এক নেতার দাবি, এই তালিকা পুলিশ করেছে। তিনি তালিকায় পুলিশের স্বাক্ষর দেখেছেন। তবে মানুষের হাতে হাতে যে তালিকা ঘুরছে তাতে পুলিশের কোনো স্বাক্ষর নেই। এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. গাজিউর রহমান জানান, পুলিশ ছাড়াও সরকারের অন্যান্য সংস্থা তালিকা করে থাকে। তালিকাটি গাজিউর রহমান দেখেননি। না দেখে বলতে তিনি মন্তব্য করতে চাননি। তার মতে, সরকারি কোনো সংস্থার তালিকা এভাবে ছড়িয়ে পড়ার কথা নয়। তবে তিনি মনে করেন তালিকায় থাকা ব্যক্তিরা যদি সত্যিই চাঁদাবাজ হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তিনি বলেন, “গণমাধ্যমের উচিত পুলিশকে এদের সম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করা। বিএনপির ওপর মহলও তো চাঁদাবাজদের সমর্থন করছে না।” তালিকায় ছাত্রদলের এক নেতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৫ই আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া ভুয়া মামলা বাণিজ্য চলছে রমরমা। এছাড়াও তিনি নগরীর বিভিন্ন কোচিং সেন্টার থেকে চাঁদাবাজি করেছেন তিনি। তালিকায় মহানগর বিএনপির একজন যুগ্ম আহ্বায়ক সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৫ই আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি করছেন তিনি। মহানগর বিএনপির এক সদস্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, নগরের বোয়ালিয়া থানাধীন ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি করেন তিনি। নগরের ভুবনমোহন পার্কে তার সাইকেলের গ্যারেজ আছে। জামায়াতের এক অস্ত্রধারী ক্যাডার সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভূমি দখল ও কেনাবেচা, বিভিন্ন গণমাধ্যম ব্যক্তিদের হুমকি-ধমকি ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা দিয়ে চাঁদা আদায় করেন তিনি। জামায়াতের আরও যাদের নাম দেওয়া হয়েছে, তাদের সবার নামে প্রায় একই ধরনের অভিযোগ তোলা হয়েছে। তাদের একজনের বিরুদ্ধে মাদক কারবারির অভিযোগ আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিতে যোগ দেওয়া একজনকে দেশীয় অস্ত্রধারী ক্যাডার, গভীর রাতে রাস্তায় চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন নির্মাণাধীন ভবন থেকে চাঁদাবাজি করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম জানা তিনি এই তালিকা দেখে হতবাক হয়েছেন। কোন সংস্থা বা কে করেছেন, জানা নেই, তবে সারা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে এই তালিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। হতে পারে দু-একজন জড়িত, কিন্তু ঢালাওভাবে নাম দেওয়া-এটা হতে পারে না। কিছু কিছু লোককে তারা চাঁদাবাজ হিসেবে চেনেন, তালিকায় তাদের নাম দেখা যায়নি। তিনি বলেন, চাঁদাবাজদের শনাক্ত করা খুবই সোজা। দেখতে হবে কারা ৫ই আগস্টের পর আওয়ামী লীগের নামে ঢালাও মামলা করেছে। হয়তো পাঁচজন বা দশজন লোক ঘটনার সঙ্গে জড়িত। তারা নাম দিয়েছে ৪০০ জনের। যারা এই সব মামলার বাদী তারাই তো চাঁদাবাজ। তবে যারা অপরাধ করেছে তাদের নামে মামলা করা অপরাধ নয়। বিএনপির এই নেতা বলেন, এখন সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় প্রশাসনের লোকজন কাকে ফিডব্যাক দিচ্ছে এটা বোধগম্য না। তারা চাচ্ছে দেশে আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হোক। এটা তাদের চক্রান্তের একটা অংশ হতে পারে। এরা তিন-চারটা করে পদোন্নতি নিয়েছে। আগে আওয়ামী লীগ সাজতে গিয়েছিল, এখন ভালো মানুষ সাজতে যাচ্ছে। মুখোশধারী এরা। তিনি বলেন, রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে এই তালিকার বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। পুলিশ কমিশনার তাকে কোথাকার কী কল রেকর্ড-এই সব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি পুলিশ কমিশনারকে বলেছেন, ‘আপনি তদন্ত করেন আবার।’ রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সেক্রেটারি এমাজউদ্দিন মণ্ডল বলেন, যাদের নাম তালিকায় আছে, তাদের সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ বয়কট করা হয়েছে। নেতাদেরও বলে দেওয়া হয়েছে কারও কাছে যেন তারা ঘেঁষতে না পারেন। এরপরেও সুযোগ পেলেই কারও পাশে দাঁড়িয়ে হয়তো ছবি তুলে প্রচার করে তারা।