মশা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ

২৬ জুলাই, ২০২৫ | ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন দেশের প্রায় সব এলাকার জনগণ। এর আগে এই রোগ রাজধানী ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা একযোগে সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে। চলতি বছরে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুতে ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ হাজার ৬২৫ জন। এডিস মশা থেকে বিভিন্ন ধরনের রোগ হলেও এবার ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাদের মতে, দেশের সিংহভাগ এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার কাঠামো নেই। যদিও ঢাকার দুই সিটিসহ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় কমবেশি জনবল রয়েছে। তবে বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা না করায় সেখান থেকে কার্যত সুফল মিলছে না। এর বাইরের এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো বলে কিছুই নেই। এই অবস্থায় এডিসের বিস্তার যেমন হওয়ার কথা তেমনই হচ্ছে। সবমিলিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে এখন পর্যন্ত সরকার কার্যত ব্যর্থ বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের আরও অভিমত-বাংলাদেশ সরকার করোনা সংক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানো এই ভাইরাসটি মোকাবিলা করা খুবই চ্যালেঞ্জিং ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেতৃত্বে কার্যকর সমন্বয়ের ফলে এটা সম্ভব হয়। কিন্তু ২০০০ সালে শুরু হওয়া এডিস মশার উপদ্রব এখনো বলবৎ রয়েছে। শুরুর পর প্রতিবছরই কমবেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে মানুষ। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাসসহ বহুবিধ রোগের বাহক এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকার অবগত হলেও কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় তা নিরসন হচ্ছে না। তারা বলেন, ২০০০ সাল থেকে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে বাংলাদেশে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এই ২৫ বছরে এডিস মশার কামড়ে কয়েক হাজার মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন কয়েক লাখ। এসব জনগণের শারীরিক কষ্ট ভোগ করার পাশাপাশি চিকিৎসা ব্যয় নিজেদের গুনতে হয়েছে। অথচ বিশ্বের অনেক দেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যয় সরকার বহন করে। একদিকে সরকার মশা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ, অন্যদিকে চিকিৎসা ব্যয়ও বহন করছে না। তাহলে জনগণ যাবে কোথায়? সরকারকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তারা আরও বলেন, ২৫ বছর আগে বাংলাদেশে ঢাকায় প্রথম ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত এডিস মশা শনাক্ত হয়। সে বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন আক্রান্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ৯৩ জন মারা যান। শুরুতে পর্যাপ্তসংখ্যক কীটতত্ত্ববিদদের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হলেও বছর না যেতেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে গতানুগতিক পদ্ধতিতে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফেলে আসা সময়ের কোনো মৌসুমে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি ছিল, কোনো মৌসুমে কম ছিল। সরকারের বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকর উদ্যোগের অভাব এবং পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধাপে ধাপে এডিস মশার বিস্তার বেড়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো অর্পিত কাজকে গুরুত্ব না দেওয়ায় এখনো পদ্ধতিগত কাঠামো গড়ে ওঠেনি। ফলে বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা এ দেশে শক্তভাবে জেঁকে বসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত হিসাবে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭০ জন। এর মধ্যে নারী ৪৭.১ শতাংশ এবং পুরুষ ৫২.৯ শতাংশ। সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে রোগী ৩৯ জন এবং সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরের রোগী ৩১ জন। জানুয়ারি মাসে মারা গেছেন-১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩ জন, মার্চে মৃত্যু নেই, এপ্রিল মাসে ৭ জন, মে মাসে ৩ জন, জুন মাসে ১৯ এবং চলতি জুলাই মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত মারা গেছেন ২৮ জন। আর চলতি বছরের শুরু থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে আক্রান্ত হয়েছেন-১৮ হাজার ৬২৫ জন। এর মধ্যে নারী ৪১.৪ শতাংশ এবং পুরুষ ৫৮.৬ শতাংশ। সিটি করপোরেশন এলাকায় আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ২০ জন। আর সিটি করপোরেশনের বাইরে আক্রান্ত হয়েছেন ১৪ হাজার ৬০৫ জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে আক্রান্ত হয়েছেন-১ হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চ মাসে ৩৩৬ জন, এপ্রিল মাসে ৭০১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৭৭৩ জন, জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫১ জন এবং জুলাই মাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৩২৯ জন। বিশেষজ্ঞদের অভিমত : এ প্রসঙ্গে কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে কার্যত কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাংলাদেশে ৫ থেকে ৬ মাস বর্ষাকাল; এ কারণে এখানে এডিস মশা বা এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ। ১০ থেকে ১১ মাস ধরে বর্ষা থাকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায়, সেখানেও তারা এডিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন। তাহলে বাংলাদেশেও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক কাজগুলোর যথাযথভাবে বাস্তবায়ন দরকার। এসব বিষয় আলাপ-আলোচনা হয়, সরকার একমত পোষণ করলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে কমবেশি জনবল থাকলেও বাইরের বিশাল এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণে কোনো জনবল নেই। সেদিকে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। মশক নিবারণী পরিদপ্তরকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেটা না হলেও সরকারকে অন্য বিকল্প ভাবতে হবে। কেননা বাংলাদেশের মতো আবহাওয়ার দেশগুলোতে এডিস মশার প্রজনন থাকবে। সেটা হলে সিটি ও পৌর এলাকার বাইরের জনগণকেও এডিস মশার হাত থেকে বাঁচাতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব গবেষণাগারে সব সময়ই মশা ও মশাবাহিত রোগ নিয়ে গবেষণা করা হয়। সেখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা, মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতাসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে মাল্টিভেরিয়্যান্ট অ্যানালাইসিস করে ফোরকাস্টিং মডেল তৈরি করেছে। এর মাধ্য ওই এডিস মশার ঘনত্বের আগাম ধারণা দেওয়া যায়। ওই গবেষণাগার থেকে এখন পর্যন্ত যত আগাম তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার সবগুলোই সঠিক হয়েছে। তিনি জানান, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তার নেতৃত্বে গবেষণাগারের সদস্যরা একটি মডেল তৈরি করেছেন। ওই মডেল বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে দাবি এই কীটতত্ত্ববিদের। তার মডেলে বলা হয়েছে, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়-স্বাস্থ্যকর্মী, ক্লিনার, মশককর্মী, সুপারভাইজার, সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা থাকবে। যাদের কাজ নির্ধারিত থাকবে, তারা সেগুলো যথানিয়মে পালন করবে। এসব কর্মী স্থায়ীভাবে নেওয়ার প্রয়োজন নেই, আউটসোর্সিংয়েও করা যেতে পারে। এছাড়া প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পর্যাপ্ত কীটনাশকের সংস্থান, রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ করতে হবে। তিনি আরও জানান, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু যেহেতু সিটি করপোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সেহেতু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের প্রতিটি জায়গায় মশক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের নেতৃত্বে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু সেখান থেকে কার্যকর সুফল মিলছে না। মশার ওষুধ শুধু সিটি করপোরেশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। সব এলাকার জন্য সরকারকে এই আয়োজন করতে হবে। তিনি বলেন, করোনার সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নেতৃত্বে সমন্বয় করা হয়। সেখান থেকে কার্যকর সমন্বয় হওয়ায় সুফল মেলে। এখনো সরকার চাইলে তা করতে পারে। ডেঙ্গুর বিষয়টি হালকাভাবে দেখলে চলবে না। এটি বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে এভাবে চলতেই থাকবে, একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে এমনটি হতে পারে না। কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার সচিবের রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগ কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ কারণে গত বছরের তুলনায় এবারের পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিদিনের চিত্র তারা পর্যালোচনা করছে এবং সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, সিটি ও পৌরসভার বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণে জনবল কাঠামো নেই। তবে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের মশক নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে। তবে এটা টেকসই কোনো পদ্ধতি নয়। টেকসই পদ্ধতি তো একদিনে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য সরকার ভাবছে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।