গোপালগঞ্জে সৃষ্টি হলো ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়

২৩ জুলাই, ২০২৫ | ৫:৩১ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে ২১ জুলাই অনুষ্ঠিত এক বিক্ষোভ-সমাবেশে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন সরকার ও তাদের পেটুয়া বাহিনী এনসিপির অপতৎপরতার কঠোর সমালোচনা এবং এহেন দু:শাসনের সহযোগী হিসেবে সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। গত বছরের ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গণমাধ্যমে প্রদত্ত বক্তব্যে সেনা প্রধান ওয়াকারউজ্জামান অঙ্গিকার করেন যে তিনি জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলেন। এরপর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে ‘ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা’ দিয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে। কিন্তু বাস্তবে জানমালের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীকে ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে দেখা যায়নি ১৫ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত-এমন অভিযোগ করে বক্তারা বলেন, ৫ আগস্ট থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শতশত নেতা-কর্মী-সমর্থককে প্রকাশ্যে হত্যা, তাদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটতরাজ শেষে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনটি বোলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয় সেনাবাহিনীর সামনে। কখনো সেনাবাহিনীকে তৎপর হতে দেখা যায়নি বলেও অভিযোগ করেন বক্তারা। অধিকন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীকে মোহাম্মদ ইউনূসের তল্পিবাহক হিসেবে দেখা গেছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার লংঘনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে সেনাবাহিনী, তাই জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনের ন্যূনতম যোগ্যতাও থাকতে পারে না সেই বাহিনীর কোন সদস্যের-এমন গুরুতর অভিযোগে বক্তব্য প্রদানের পর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ মহাসচিব বরাবরে একটি স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৬ জুলাই জাতীয় নাগরিক পার্টি(এনসিপি)’র সমাবেশকে কেন্দ্র করে গোপালগঞ্জের প্রতিবাদী জনসাধারণের ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়েছে। ইউনূস সরকারের মদদে সেনাবাহিনী ও পুলিশসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্তত: ৯জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। ময়না তদন্ত ছাড়া লাশ দাফনে বাধ্য করা হয়েছ। অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে গণগ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আরো উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ জুলাই যুক্ত হলো আরেকটি কালোঅধ্যায়। এই দিনটি যেন একাত্তরের ২৫ মার্চের বিভীষিকাকেও নতুন করে মনে করিয়ে দিয়েছে। এদিন গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে, তা কোনো রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়। এটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, নির্মম, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নগ্ন উদাহরণ। সেদিন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার রক্তাক্ত পরিণতি ঘটেছে। এই ঘটনা ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত দাগ হয়ে থাকবে। এটি আমাদের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর সরাসরি আঘাত। এই ঘটনায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়নি। এর দায় রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরের। এই ঘটনা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রকৃত চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। গোপালগঞ্জে গণতন্ত্রের কবর রচনা বলে উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে বলা হয়, ১ জুলাই থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দেশব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে ১৬ জুলাই ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ও সমাবেশের ডাক দেয়। কিন্তু এই তথাকথিত কর্মসূচির আড়ালে ছিল সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তাদের লক্ষ্য ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি গোপালগঞ্জকে কলঙ্কিত করা। তাঁর স্মৃতি ও আদর্শকে অপমান করা। সর্বোপরি জাতির পিতার মাজারে আঘাত হানার মতো জঘন্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করা। গোপালগঞ্জবাসী, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এবং জাতির মর্যাদা রক্ষায় রাজপথে নেমেছিল এই ষড়যন্ত্র প্রতিরোধে। নারী, তরুণ এমনকি বৃদ্ধরাও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন দেশদ্রোহী চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। জনসাধারণের এই প্রতিরোধ আন্দোলনের জবাবে যা ঘটল তা কল্পনাকেও হার মানায়। অন্তর্বর্তী সরকারের ছত্রছায়ায় সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, আনসার-সহ সকল রাষ্ট্রীয় বাহিনী গোপালগঞ্জে আসে এক ভয়ঙ্কর অভিযান চালাতে। তারা জনতার ওপর গুলি চালায়। লাঠিচার্জ করে। বুটের তলায় মানবতা। রাস্তায় পড়ে থাকা নিরীহ মানুষকে বুট দিয়ে পিষে মারার দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে দেশের গণমাধ্যম। সেদিন ৯ জন নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। রাজপথে আহত মৃত্যুপথযাত্রী তরুণ সোহেল রানাকে টেনে-হিঁচড়ে রাজপথে বুটের তলায় গলা চেপে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এ দৃশ্য দেখে কাঁদেনি এমন মানুষ নেই। সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায় রমজান কাজী নামের আরেক তরুণকে পুলিশের হেফাজতে নির্যাতিত হতে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তার রক্তাক্ত, গুলিবিদ্ধ লাশ। রমজানের অপরাধ, সে বঙ্গবন্ধুর সমাধি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রশংসিত সেনাবাহিনী কীভাবে নিজ দেশে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? এ প্রশ্ন উঠেছে আজ বিশ্বজুড়ে। গোপালগঞ্জে যা ঘটেছে, তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের প্রতি স্পষ্ট অবমাননা। নিরস্ত্র জনতার উপর সরাসরি গুলিবর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যা এবং ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফনের ঘটনাগুলো প্রমাণ করে গোপালগঞ্জে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। নিহতদের পরিবার জানিয়েছে, তাদের সন্তানদের মরদেহ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য করা হয়েছে। কোনো সরকারি সহায়তা আসেনি, বরং লাশ নিয়ে ‘ঝামেলা না করতে’ হুমকিও এসেছে প্রশাসনের তরফ থেকে। গণতন্ত্রে যেখানে প্রতিটি প্রাণের মূল্য থাকার কথা, সেখানে গোপালগঞ্জে জীবন মানে শুধু শংকা। রাষ্ট্র চায় এই রক্তের দাগ মুছে ফেলতে। সত্য গোপন করতে। ১৬ জুলাই ঘটনার পরপরই ২২ ঘণ্টার জন্যে গোপালগঞ্জে কারফিউ জারি করা হয়। শহর পরিণত হয় এক ভূতের নগরীতে। মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেনি। সাংবাদিকদের প্রবেশ বন্ধ। ছাত্র-ছাত্রীদের পরীক্ষা বাতিল। সবমিলিয়ে একটি মুক্ত শহরকে নাগরিক কারাগারে পরিণত করা হয়। নাগরিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের অধিকার সবকিছু রুদ্ধ করা হয় সরকারী আদেশে। গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যাচ্ছে, পুলিশ গোপালগঞ্জে এপর্যন্ত ৮টি মামলা দায়ের করেছে। আসামি করা হয়েছে ৮৪০৮ জনকে। এর মধ্যে মাত্র ৩৫৮ জনের নাম উল্লেখ আছে, বাকিরা সবাই ‘অজ্ঞাত’। গ্রেপ্তারকৃতদের অনেকেই রিকশাচালক, কৃষক, শিক্ষক। তাদের অধিকাংশই সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত নন। এই গণ মামলাই প্রমাণ করেছে গোপালগঞ্জে রাষ্ট্র রাজনৈতিক প্রতিশোধ পরায়ণতা চালাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠছে গোপালগঞ্জ কি কেবল বাংলাদেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ? গাজা, কিয়েভ, সুদান নিয়ে উচ্চবাচ্য হয়, কিন্তু গোপালগঞ্জের রক্তস্নাত রাজপথ কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের মানচিত্রে পড়ে না? জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-তারা কি চোখ বন্ধ রেখেছে? জাতিসংঘের সামনের এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ড.সিদ্দিকুর রহমান। সভা পরিচলনা করেন যুগ্ম সাধারন সম্পাদক নুরল আমিন বাবু। নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র আওযামী লীগের সহ-সভাপতি ডা: মাসুদুল হাসান, সহ-সভাপতি সামছুউদ্দীন আজাদ, আশরাফ উদ্দীন, সাংগঠনিক সম্পাদক ইমদাদ রাজু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আব্দুল হামিদ, কার্ষকরি সমস্য শাহানারা রহমান, জহিরুল ইসলাম, মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ শাহনাজ, নিউইয়র্ক ষ্টেট আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক শাহীন আজমল, নিউইযর্ক মহানগর আওযামী লীগের সভাপতি রফিকুর রহমান, সাধারন সম্পাদক ইমদাদ চৌধুরী, যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল, আওয়ামী লীগ নেতা ইকবাল হোসেন, যুক্তরাষ্ট্র যুবলীগ নেতা শেখ জামাল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ইকবাল হোসেন ও গোলাম কিবরিয়া, ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান প্রমুখ। এ সময় জানানো হয় যে, আসছে শুক্রবার বেলা ১২টা থেকে অপরাহ্ন ৩টা পর্যন্ত ওয়াশিংটন ডিসিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে আবারো মানববন্ধন শেষে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে ট্রাম্প প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনায়।