উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত: প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা এবং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিহীনতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি

২৩ জুলাই, ২০২৫ | ১২:৪৩ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

উত্তরায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলো এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর। নির্মমভাবে ঝরে গেছে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের প্রাণ। এই ঘটনা শুধু একটি সাধারণ দুর্ঘটনা নয়; এটি একটি রাষ্ট্রের প্রশাসনিক ও নৈতিক পতনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধবিমানের মতো জটিল ও উচ্চ ঝুঁকির ফ্লাইং অপারেশন পরিচালনায় যেখানে গভীর পর্যালোচনা-পরিকল্পনা, যান্ত্রিক পরীক্ষণ এবং সুসংগঠিত ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন, সেখানে এ ধরনের ভয়াবহ ব্যর্থতা শুধু যান্ত্রিক ত্রুটির বিষয় নয়—এটি গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীর অবক্ষয়ের প্রতিফলন। ড. ইউনুসের শাসনামলে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক কাঠামো একটি অত্যধিক কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ববাদী রূপ ধারণ করেছে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সবকিছুই চলে কাগুজে আদেশ, বিচ্ছিন্ন নির্দেশ এবং পক্ষপাতদুষ্ট আনুগত্যের ভিত্তিতে। এখানে কোনো পরামর্শভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ নেই, নেই দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ বা সম্পদের সঠিক বণ্টন। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনা, জনবল নিয়োগ ও খাতভিত্তিক বিনিয়োগ—সবই চলে ঊর্ধ্বমুখী আনুগত্যের জালে। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সশস্ত্র বাহিনীর আকাশ শাখা পর্যন্ত এই একই ধারা লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সশস্ত্র বাহিনীতে পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ এবং সমরাস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তিরা রাজনৈতিক আনুগত্যে ‘বিশ্বস্ত’, তারাই অগ্রাধিকার পেয়েছে দক্ষতার বদলে। এর ফলে যুদ্ধবিমানের মতো উচ্চ প্রযুক্তির রক্ষণাবেক্ষণ এবং কার্যকারিতা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে পড়েছে। যদি একটি রাষ্ট্র নিজের প্রশাসনিক কাঠামোর ভেতরে ব্যর্থতাকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা তৈরি করে, তবে প্রযুক্তিগত বিপর্যয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়—তা হয়ে দাঁড়ায় এক অবধারিত, কাঠামোগত দুর্বলতার ইঙ্গিত। উত্তরার দুর্ঘটনা তাই কেবল একটি যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, বরং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার অনিবার্য ফল। এই রাষ্ট্রে এখনো এমন সামরিক মহড়া হয়, যেখানে জনবহুল অঞ্চলের ওপর দিয়ে দিনদুপুরে যুদ্ধবিমান ওড়ানো হয়। এই ভয়াবহ কৌশলগত উদাসীনতা প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রের কার্যপরিচালনার স্তরে এখনো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে একটি প্রাথমিক চিন্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এমন কর্মকাণ্ড সাধারণ নাগরিকের জীবনের ঝুঁকি তৈরির মতো অপরাধের আওতায় পড়ে। অথচ এখনো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য কোনো ভূ-তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ বা নিরাপত্তা সংযোজনের প্রয়াস নেই। এমনকি সশস্ত্র বাহিনী নিজের দায়িত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে হয়ে উঠেছে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ হুমকি। ড. ইউনুসের শাসনে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর যেভাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপানো হয়েছে—যেমন প্রকল্প বাস্তবায়ন, রসদ সরবরাহ, প্রশাসনিক চাপ সামলানো—তা বাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা ভূমিকা থেকে তাদের বিচ্যুত করেছে। এর ফলে বাহিনীর ভেতরেও আর কোনো সমালোচনামূলক আত্মপর্যালোচনার সংস্কৃতি অবশিষ্ট নেই। এখন আর কেউ প্রশ্ন তোলে না—এই বিমান কেন উড়ছিল? কারা এর দায়িত্বে ছিল? প্রশিক্ষণের ঘাটতি কোথায় ছিল? যখন একটি রাষ্ট্র নিজের ভেতর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতার তোয়াক্কা করে না, তখন ভয়ের ভিত্তিতেই শাসন চলে। কিন্তু এভাবে রাষ্ট্র নিজেই একসময় নিজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। উত্তরার স্কুলের ওপর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের মানে কেবল কয়েকটি শিশু প্রাণ হারানো নয়—এটি একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি, যেখানে দুর্নীতি, লোভ এবং বিশৃঙ্খলা মিলেমিশে সাধারণ মানুষের জীবনের ওপর ধসে পড়ে। এই ঘটনায় কেবল সামরিক তদন্তই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন তুলতে হবে সেই গভীর কাঠামোগত সংকটের বিরুদ্ধে, যার ভেতর থেকে এমন দুর্ঘটনার জন্ম হচ্ছে। ড. ইউনুসের অবৈধ শাসন ও কাগুজে প্রশাসন যে এক ভয়াবহ বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, তারই রক্তাক্ত সাক্ষী হয়ে উত্তরার শিশুদের প্রাণহানি আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—এই রাষ্ট্র আর নাগরিকদের রক্ষক নয়; বরং একটি ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্র, যা প্রতিনিয়ত নিজের নাগরিকদের উপরেই ধ্বংস নামিয়ে আনতে পারে।