ঋণ জালিয়াতি : ফারমার্সের পথে পদ্মা ব্যাংক

ভুয়া সাইনবোর্ড টাঙিয়ে ঋণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন: অনুমোদনের আগে ঋণ তুলে নিয়ে গেছেন গ্রাহক, জামানত ছাড়াই ঋণ, হাজার কোটির তহবিলে ১০০ কোটি টাকা ছাড়া কিছুই নেই

২ মার্চ, ২০২৩ | ১০:১৫ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেস্ক , ইউ এস বাংলা ২৪

খাদের কিনারে থাকা পদ্মা ব্যাংকে আবারও ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতি হয়েছে। অনুমোদনের আগে ঋণ তুলে নিয়ে গেছেন গ্রাহক। Advertisement এমনকি মর্টগেজকৃত সম্পত্তিতে ভুয়া সাইনবোর্ড টাঙানো হয়। খেলাপি এড়াতে এক ঋণকে অন্য ঋণে রূপান্তর এবং বেশকিছু ঋণ দেওয়া হয়েছে জামানত ছাড়াই। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। ব্যাংক খাতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভয়াবহ সব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে নতুন প্রজন্মের ফারমার্স ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করার ৭ বছরের মাথায় এসে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। গ্রাহকের আস্থা ফেরাতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়, যে কারণে ডুবেছিল ফারমার্স ঠিক সেই একই পথে হাঁটছে পদ্মাও। তাদের মতে, এ ধরনের প্রমাণিত তথ্য যখন গ্রাহকরা জানবেন তখন তাদের মধ্যে আস্থাহীনতার চরম সংকট তৈরি হবে। ফারমার্স ব্যাংক যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালে। ২০১৯ সালে এসে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পদ্মা ব্যাংক। ওই সময় প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বেশি অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটি পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারেক রিয়াজ খান বুধবার বলেন, ‘আমরা এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের এমওইউর আওতায় আছি। আগের থেকে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনছি। আরও কমিয়ে আনব। এ মুহূর্তে কোনো নতুন ঋণ দিচ্ছি না। বকেয়া আদায়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকটির শাখায় শাখায় গুরুতর অনিয়ম ছড়িয়ে পড়েছে। ছোট-বড় অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে উঠেছে পদ্মা ব্যাংক। গুলশান করপোরেট শাখা : এই শাখায় পরিদর্শনের সময় এমএস ইন্টারন্যাশনাল গ্রাহক প্রতিষ্ঠানের পুনঃতফতিল করা মেয়াদি ঋণের বকেয়া স্থিতি ৩৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ১৯ জুন ঋণটি নবায়ন করা হয় এবং ওই ঋণের সীমাতিরিক্ত ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা নতুন একটি মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শকরা বলছেন, সিসি ঋণের সীমাতিরিক্ত অংশ মেয়াদি ঋণে রূপান্তর করা হয় মূলত শ্রেণিকরণ বা খেলাপি এড়ানোর জন্য, যা ব্যাংক রীতিনীতির পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একই শাখায় এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট গ্রাহক প্রতিষ্ঠানেরও একটি অনিয়ম সংঘটিত হয়। পরিদর্শনের সময় গ্রাহকের চলমান ও মেয়াদি ঋণের বকেয়া স্থিতি ছিল প্রায় ১৮ কোটি টাকা। অথচ মর্টগেজ সম্পত্তির মূল দলিল ঋণ নথিতে পাওয়া যায়নি। এমনকি মর্টগেজকৃত সম্পত্তিতে পদ্মা ব্যাংকের সাইনবোর্ডও লাগানো হয়নি। যদিও ভ্যালুয়েশন প্রতিবেদনের প্রথম পৃষ্ঠায় সাইনবোর্ডের একটি ছবি দৃশ্যমান। কিন্তু তা ফেক বা এডিট করে লাগানো হয়েছে বলে পরিদর্শক দল মনে করে। একই স্থানের অন্যান্য ছবিতেও আলোচ্য সাইনবোর্ডটি দেখা যায়নি। অর্থাৎ সাইনবোর্ডটি ভুয়া। নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ঋণ বিতরণ : পদ্মা ব্যাংকের মিরপুর শাখায় লুব কেয়ার বিডির কাছে পুনঃতফসিল করা প্রায় ১৯ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালের ২০ আগস্ট সাড়ে তিন কোটি টাকার মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণসীমা ৬ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। যদিও সে সময় ব্যাংকটির ঋণ বিতরণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিষেধাজ্ঞা ছিল। তা অমান্য করে ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এ ঋণের সহায়ক জামানত নেওয়ার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত তা নেওয়া হয়নি। একই শাখার এমআর ট্রেডিংয়ের কাছে পদ্মা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১৭ কোটি টাকা। এসব ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জামানত ঠিক নেই। ব্যাংকের সাইনবোর্ড নেই। সে কারণে এসব ঋণের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মাওনা শাখায় অনিয়মের ছড়াছড়ি : এই শাখায় মেসার্স খান অয়েল মিলের ঋণ অনুমোদন করা হয় ২০১৭ সালের ৪ এপ্রিল। অথচ গ্রাহক ঋণ তুলে নিয়েছে একই বছরের ২ এপ্রিল। অর্থাৎ অনুমোদনের দুই দিন আগেই গ্রাহক ৬০ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন। পরিদর্শনের সময় গ্রাহকের কাছে পাওনা ছিল ১ কোটি টাকার বেশি। এতে বোঝা যাচ্ছে, সংশ্লিষ্ট গ্রাহক কোনো টাকা পরিশোধ করেননি। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের ট্রেড লাইসেন্সের স্বাক্ষরের সঙ্গে ২০১৯ ও ২০২০ সালের ট্রেড লাইসেন্সের স্বাক্ষরের মিল নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল মনে করে, একই ব্যক্তি বা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে ইস্যু করা ট্রেড লাইসেন্সের ভিন্ন ভিন্ন স্বাক্ষর প্রতীয়মান করে ট্রেড লাইসেন্সগুলো সঠিক নয়। এছাড়া বন্ধকী সম্পত্তির দলিলদাতার এনআইডি কার্ডের সঙ্গে দলিলের নামের গরমিল রয়েছে। মাওনা শাখার অপর গ্রাহক মেসার্স ইমতিয়াজ আহমেদ শামসুল হুদা। এই গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের পাওনা ১১ কোটি টাকার বেশি। ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট চলমান ঋণের পুরো টাকা তুলে নিয়ে গেছেন গ্রাহক। আজ পর্যন্ত কোনো টাকা ফেরত দেননি। পরিদর্শক দল মনে করে, আলোচ্য ঋণ হিসাবের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য, ব্যবসা পরিচালনা নয়। এভাবে গাজীপুরের মাওনা শাখায় ঋণ জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। একইভাবে জামালপুরের বকশীগঞ্জ শাখা ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখায় বড় অঙ্কের টাকার নয়ছয় হয়েছে। ব্যাংকের টাকা চেয়ারম্যানের নিজ প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ : অলটারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড অব বাংলাদেশ। এ তহবিলের মূলধন ১১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০০ কোটি টাকাই পদ্মা ব্যাংকের। আর অন্য ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ মাত্র ১০ কোটি টাকা। তহবিলের দায় ও সম্পত্তির ৮১.৬০ শতাংশ এবং নগদ বা সমমানের জমার ৮৫.৪৫ শতাংশ ‘স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডে’ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় রয়েছেন পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ব্যাংকটির বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত পেতে সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শক দল। লোকসানি তহবিলে পদ্মা ব্যাংকের বিনিয়োগ : এক হাজার কোটি টাকার তহবিলে পদ্মা ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। এটি একটি লোকসানি তহবিল। সঙ্গত কারণে দীর্ঘদিন লোকসান গুনে যাচ্ছে পদ্মা ব্যাংক। পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজ : ব্যাংকটির ১০০ কোটি পরিশোধিত মূলধনের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান পদ্মা ব্যাংক সিকিউরিটিজ। ২০১৫ সালে ডিএসইর অনুমোদন নিয়ে ব্রোকারেজ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি থেকে কোনো মুনাফা পায়নি পদ্মা ব্যাংক। বিনিয়োগ (শেয়ার ও সিকিউরিটিজ) : শেয়ার বিনিয়োগের বিষয়ে ব্যাংকের বিনিয়োগ কমিটির সুপারিশ ও অনুমোদনের দালিলিক প্রমাণাদি চাওয়া হলেও ব্যাংক তা সরবরাহ করতে পারেনি। বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি রবি’র শেয়ারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো অনুমোদন নেয়নি। ১৯৯.১৭ প্রাইস আর্নিং রেশিওতে বিনিয়োগের ফলে ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৫৮ কোটি টাকা।