আয়ারল্যান্ডে গণকবরের সন্ধান, গোপন চেম্বারে ৭৯৬ শিশুর সমাধি

১৪ জুলাই, ২০২৫ | ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

আয়ারল্যান্ডের গলওয়ের তুয়াম শহরে প্রাক্তন সেন্ট মেরিজ শিশু আশ্রমের স্থানে গণকবরের প্রমাণ মিলেছে। গণকবরের সন্ধান পান শৌখিন ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলিস।২০১৪ সালে এই স্থানে শত শত শিশুর গোপন সমাধির সন্ধান মেলে। অথচ এখানে নেই কোনো সমাধিফলক, শিলালিপি কিংবা নেই কোনো রেকর্ড। খবর: বিবিসি কাল সোমবার থেকে এই জায়গায় আনুষ্ঠানিক খননকাজ শুরু হচ্ছে। প্রায় দুই বছর ধরে খনন চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেখানে শিশুদের একটি খেলার মাঠের পাশের ঘাসের বর্গাকার জায়গায় নামানো হয়েছে খননযন্ত্র। ১৯২৫ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত এই স্থানে ছিল সেন্ট মেরিজ শিশু আশ্রম। এই চার্চ-পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটিতে আশ্রয় নিয়েছিল বিয়ে ব্যতীত জন্মানো হাজারো শিশু। সন্তান জন্মের পর মায়েদের কাছ থেকে আলাদা করা হতো শিশুদের। মৃত্যুর রেকর্ড অনুযায়ী, এই আশ্রমে প্রথম মারা যায় প্যাট্রিক ডেরেইন, মাত্র পাঁচ মাস বয়সে। সেটা ১৯১৫ সালের ঘটনা। আর সর্বশেষ মারা যায় মেরি কার্টি, একই বয়সে, ১৯৬০ সালে। মাঝের এই বছরগুলোয় আরো অন্তত ৭৯৪ শিশুর মৃত্যুর নথি রয়েছে। পিজে হাভারটি এই আশ্রমে জীবনের প্রথম ছয় বছর কাটিয়েছেন। তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন কারণ, তিনি অন্তত বের হতে পেরেছেন। তবে স্কুলে কীভাবে হোম চিলড্রেনদের আলাদা করে রাখা হতো তা আজো ভুলতে পারেননি তিনি। পিজে বলেন, ‘দশ মিনিট দেরি করে আসতে হতো, দশ মিনিট আগে বেরিয়ে যেতে হতো— যেন আমরা অন্য শিশুদের সঙ্গে কথা না বলি। বিরতিতে খেলতেও দিত না। আমাদের আলাদা করে রাখা হতো। আমরা রাস্তার ময়লা ছিলাম।‘ দত্তক পরিবারে ভালোবাসা পেয়েছেন, অনেক পরে নিজের মাকেও খুঁজে পেয়েছেন পিজে। তবে এই লাঞ্ছনার ক্ষত সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। সেন্ট মেরিজের ইতিহাসের অন্ধকার অংশ জনসমক্ষে আনেন শৌখিন ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন করলিস। ২০০৫ সালে পারিবারিক ইতিহাস জানতে একটি স্থানীয় ইতিহাস কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। পরে আগ্রহ জন্মায় ‘হোম চিলড্রেন’দের ইতিহাস নিয়ে। আপাত নিরীহ অনুসন্ধান করতে যান ক্যাথরিন। কবরস্থানের এক তত্ত্বাবধায়ক তাকে সাবেক আশ্রমের জায়গায় নিয়ে গেলে পান বড় ব্রেকথ্রু। সেখানে শিশুদের খেলার মাঠের পাশে মাদার মেরির একটি মূর্তির নিচে লন ছিল। তত্ত্বাবধায়ক জানান, আশ্রম ভেঙে ফেলার পর ৭০ এর দশকে দুই শিশু এখানে একটি কংক্রিটের স্ল্যাব টেনে তুলেছিল। তাতে খোলা একটি গর্তে পাওয়া যায় অসংখ্য হাড়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল, সেগুলো ১৮৪০ এর দশকের দুর্ভিক্ষে মৃতদের দেহাবশেষ। তবে ক্যাথরিন জানতেন, দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তিদের সমাহিত করা হয়েছিল অন্য স্থানে। পুরনো মানচিত্র যাচাই করে দেখা যায়, ১৯২৯ সালের মানচিত্রে এলাকাটি ‘সুয়েজ ট্যাঙ্ক’ নামে চিহ্নিত। অথচ ১৯৩৭ সালের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ এর মানচিত্রে হাতের লেখা ছিল ‘কবরস্থান’। গল্প জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে। রেকর্ড অফিসে শিশুদের মৃত্যুর তালিকা চেয়ে পাঠান ক্যাথরিন। এত বেশি নাম কর্মকর্তারা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি! মোট ৭৯৬ শিশুর মৃত্যুর নথি হাতে পেয়ে শিউরে ওঠেন ক্যাথরিন। কোনো কবরস্থানে সেই শিশুদের সমাধি খুঁজে পাননি তিনি। ক্রমে স্পষ্ট হয়, ওই সুয়েজ ট্যাঙ্কের নিচেই লুকিয়ে রাখা হয়েছে শত শত শিশুর লাশ। ২০১৪ সালে খবরটি আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়। তখনো অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছিল। তবে তখন সাক্ষ্য দেন মেরি মরিয়ার্টি নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৭০ এর দশকে ঘটনাস্থলে যা দেখেছিলেন তিনি, সেটাই বলে যান। একবার গর্তে পড়ে গিয়ে তিনি ছোট ছোট কাপড়ে মোড়া অসংখ্য ছোট ‘বস্তু’ দেখতে পেয়েছিলেন। কাপড়ে মোড়া সেই সারি সারি বস্তু ছিল ছাদ পর্যন্ত ঠাসা। মেরির দ্বিতীয় ছেলের জন্ম হয় তুয়ামের ম্যাটার্নিটি হাসপাতালে। সেখানে কর্মরত সেবিকা মেরির সন্তানকে তার কাছে নিয়ে আসেন 'সেই সব কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে', ঠিক যেমনটি তিনি আগে সেই গর্তে দেখেছিলেন। মেরি বলেন, ‘তখনই আমার বুঝতে বাকি থাকল না। আমি যখন সেই গর্তে পড়েছিলাম, তখন যা দেখেছিলাম সেগুলো আসলে ছিল শিশুদের দেহ।' নতুন করে খননকাজ শুরু হোক— এমনটি চাইছেন অনেকেই। তার মাঝে একজন আনা করিগান। তিনি অনেক পরে জানতে পারেন, তার মাও সেখানে দুই ছেলে জন্ম দিয়েছিলেন— জন এবং উইলিয়াম। জনের মৃত্যুর সনদ মেলে। মৃত্যুর কারণ লেখা ‘জন্মগত মানসিক অক্ষমতা’ ও ‘হাম’। মৃত্যুর আগে শিশুটি কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। উইলিয়ামের কোনো সনদই খুঁজে পাননি আনা। তিনি বলেন, ‘এখন অন্তত আমরা জানি, ওরা মানুষ ছিল। তাদের নাম আছে।‘ ২০১৭ সালে আইরিশ সরকারের প্রাথমিক খননে ‘মানব দেহাবশেষের বড় উপস্থিতি’ নিশ্চিত হয়। এখন আনুষ্ঠানিক খনন শুরু হচ্ছে। প্রধান সমন্বয়ক ড্যানিয়েল ম্যাকসুইনি জানান, শিশুদের হাড় এত ছোট যে তা প্রাপ্তবয়স্কের আঙুলের সমান। শনাক্তকরণের কাজ অত্যন্ত জটিল। এতে প্রায় দুই বছর সময় লাগবে। আনা এবং আরো অনেকেই অপেক্ষায় থাকবেন সেই ভাইবোন, মামা-চাচাদের খবরের জন্য, যাদের কখনোই তারা দেখতে পাননি।