গাজায় ফুরিয়ে আসছে রক্ত!

আমি খান ইউনিস শহরের পশ্চিমাংশে অবস্থিত আল নাসের হাসপাতালের কাছেই থাকি। প্রায় প্রতিদিনই হাসপাতালের লাউডস্পিকারে রক্তদানের জন্য ব্যাকুল আহ্বান শুনতে পাই। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এটা নিয়মিত ঘটছে। নাসের হাসপাতাল গাজার অন্যান্য ধুঁকতে থাকা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মতোই ইসরাইলি বিমান হামলায় আহত অসংখ্য মানুষের চাপে বিপর্যস্ত। গত মে মাসের শেষ দিক থেকে এই হাসপাতালে আরো বহু আহত ফিলিস্তিনিকে ভর্তি করা হয়েছেন। এ বেসামরিক মানুষদের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ইসরাইলি সেনারা গুলি করেছেন। আমি আগেও রক্তদান করেছি এবং আবার করাটাই আমার দায়িত্ব মনে হলো। তাই গত মাসে এক সকালে আমি নাসের হাসপাতালে গেলাম। আমার হাত থেকে যখন রক্ত নেওয়া হচ্ছিল তখন হঠাৎ ভীষণ মাথা ঘুরে উঠল, মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাব। আমার বন্ধু নার্স হানান—যিনি ওই রক্তদান কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—দ্রুত ছুটে এলেন, আমার পা উপরে তুলে ধরলেন যাতে রক্ত মস্তিষ্কে প্রবাহিত হয় এবং আমি একটু স্বস্তি পাই। পরে তিনি আমার রক্ত পরীক্ষা করতে গেলেন। ১০ মিনিট পর ফিরে এসে জানালেন, আমি মারাত্মক রকম রক্তাল্পতা ও অপুষ্টিতে ভুগছি। আমার রক্তে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ নেই, যা রক্তদানের জন্য দরকার। হানান জানান, আমার অবস্থা কোনো ব্যতিক্রম নয়। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, যারা রক্ত দিতে হাসপাতালে আসছেন, তাদের বেশিরভাগই রক্তস্বল্পতা ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। এর কারণ ইসরাইলি অবরোধ। পুষ্টিকর খাবার যেমন—মাংস, দুধ, ডিম, ফল—এর অভাবে সকলেই অপুষ্টিতে ভুগছেন। হাসপাতালে দান করা দুই-তৃতীয়াংশ রক্তেই হিমোগ্লোবিন ও আয়রনের মাত্রা এত কম থাকে যে তা রক্তসঞ্চারে ব্যবহারের উপযোগী নয়। জুনের শুরুতে হাসপাতালের ল্যাবরেটরি ও ব্লাড ব্যাংকের পরিচালক ডা. সোফিয়া জা’রাব সংবাদমাধ্যমকে জানান, দান করা রক্তের মারাত্মক ঘাটতি এখন ‘সঙ্কটজনক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা জরুরি রক্তের প্রয়োজন এমন বহু রোগীর জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। পুরো গাজায় প্রতিদিন প্রয়োজন ৪০০ ইউনিট রক্ত। ‘আমরা পশ্চিম তীরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম রক্ত পাঠানোর জন্য, কিন্তু দখলদার বাহিনী সেগুলোর গাজায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে,’ বলেন ডা. জা’রাব। রক্তদানে ব্যর্থ হয়ে আমি হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরলাম। আমি জানতাম দুর্ভিক্ষ আমাকে গ্রাস করছে। আমার ওজন অনেক কমে গেছে। আমি সবসময় ক্লান্ত থাকি, জয়েন্টে ব্যথা, মাথাব্যথা আর মাথা ঘোরা লেগেই থাকে। এমনকি সাংবাদিকতা করি বা পড়াশোনা করি, তখনও বারবার বিরতি নিতে হয়। তবে আমার স্বাস্থ্য কতটা খারাপ, সেটা যেভাবে প্রকাশ পেল তা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। বহু মাস ধরে আমার পরিবার আর আমি শুধু পাস্তা আর ভাত খাচ্ছি, কারণ আটা কিনতে খরচ অত্যন্ত বেশি। দিনে এক বেলা খাই, কখনো কখনো তা-ও নয়, ছোট ভাইবোনদের বেশি খাবার দেওয়ার জন্য নিজেরা কম খাই। তাদের অপুষ্টিতে ভোগার ভয় আমাকে সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। তাদের ওজনও কমে গেছে, আর তারা সারাক্ষণ খাবারের জন্য কাঁদে। মার্চের ২ তারিখ থেকে ইসরাইল পূর্ণ অবরোধ আরোপের পর থেকে আমরা মাংস, ডিম, দুধ এসব একবারও খাইনি—সত্যি বলতে তার আগেও সেগুলো খুব কমই জুটত। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরাইলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৬৬ জন শিশু অনাহারে মারা গেছে। ইউনিসেফ বলছে, মে মাসেই গাজা জুড়ে ৫,০০০-এর বেশি শিশুকে গুরুতর অপুষ্টিজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। এই শিশুদের কেউ কেউ হয়তো অলৌকিকভাবে বেঁচে যাবে, কিন্তু তারা আর কখনো সুস্থভাবে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে না, তাদের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে, তারা নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারবে না। তবে আমার ও পরিবারের সদস্যদের শারীরিক দুরবস্থার চিন্তার চেয়েও আমাকে বেশি ব্যথিত করেছে ইসরাইলি বিমান হামলায় আহত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে না পারার কষ্ট। একজন মানুষ হিসেবে আমার জায়গা থেকে আমি যুদ্ধাহত মানুষদের সাহায্য করতে চেয়েছিলাম। অন্য মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা আমাদের মানবিক প্রবৃত্তির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই সংহতিই আমাদের মানবতার পরিচয়। কিন্তু যখন আপনি কাউকে বাঁচাতে চান, কিন্তু পারছেন না—তখন এক নতুন মাত্রার হতাশা শুরু হয়। যখন আপনি আপনার সামান্য যা কিছু আছে, এমনকি নিজের শরীরের অংশ—তাও দিয়ে সাহায্য করতে চান, কিন্তু সে সুযোগও কেড়ে নেওয়া হয়, তখন হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়। ২১ মাস ধরে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মানবাধিকারের সবকিছু—যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত: পানি ও খাদ্যের অধিকার, চিকিৎসা ও আবাসনের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, চলাচল ও আশ্রয়ের অধিকার, জীবনের অধিকার। এখন আমরা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে অন্যকে সাহায্য করার ইচ্ছাটুকুও—অর্থাৎ সংহতি প্রকাশের অধিকারটিও—আমাদের অস্বীকার করা হচ্ছে। এটি কাকতালীয় নয়—এটি পরিকল্পিত। এই গণহত্যা শুধু মানুষকে হত্যা করছে না, মানুষের ভেতরের মানবতা ও পারস্পরিক সহমর্মিতাকেও টার্গেট করছে। দাতব্য সংস্থা ও কমিউনিটি রান্নাঘরগুলোর ওপর বোমা বর্ষণ, মানুষকে ছুরি হাতে নিয়ে খাবার ছিনিয়ে নিতে উসকানি দেওয়া—এগুলো সবই সেই ঐক্যবদ্ধতা ভাঙার চেষ্টা, যা ৭৫ বছরের নিপীড়ন আর অধিকারচ্যুতির মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের টিকিয়ে রেখেছে। হয়তো আমাদের সামাজিক বন্ধনে ফাটল ধরেছে, কিন্তু আমরা তা মেরামত করব। গাজা একটা বড় পরিবার, আর আমরা জানি কিভাবে একে অপরকে সান্ত্বনা দিতে হয়, কিভাবে সহায়তা করতে হয়। ফিলিস্তিনি জাতির মানবতা সবসময়ই বিজয়ী থেকেছে—এখনও থাকবে। অনুবাদ: খালিদ হাসান সূত্র: আল-জাজিরা