দারিদ্র্যের মাধ্যমে মুমিনের পরীক্ষা

সচ্ছলতা ও দারিদ্র্য পৃথিবীর সমাজ জীবনে আবহমান কালের বাস্তবতা। মহান আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদে প্রাচুর্যপূর্ণ হয়ে কেউ আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ ব্যয় করে থাকে। আবার কেউ অহংকারী হয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এটা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা। ধনাঢ্যতা যেমন বড় পরীক্ষা, তেমনি দারিদ্র্যও এক বিরাট পরীক্ষা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফল-ফলাদির স্বল্পতার মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও।’ (সুরা বাকারা: ১৫৫)। দারিদ্র্য যেহেতু একটি পরীক্ষা, অবশ্যই ধৈর্যশীল হতে হবে। জেনে রাখা উচিত, সচ্ছলতা শুধু প্রাচুর্যতায় নয়; দারিদ্র্যের মাঝেও তা লুকিয়ে থাকে, যদি ধৈর্যের সঙ্গে তাকে অনুভব করা যায়। যারা দারিদ্র্যের মাঝেও আল্লাহর ওপর ভরসা রাখে এবং ধৈর্যধারণ করে তাদের উদ্দেশে আল্লাহ বলেন, ‘যারা ধৈর্যধারণ করে কষ্ট ও দুর্দশায় এবং যুদ্ধের সময়ে, তারাই সত্যবাদী এবং তারাই মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা: ১৭৭) দারিদ্র্য কখনো হতাশার কারণ নয়। এখন দেখা যায় দারিদ্র্যে নিপতিত ব্যক্তিদের চেহারা হতাশার জালে আবৃত। আমরা যখন একটু অসচ্ছল হয়ে পড়ি তখন শয়তান আমাদের অন্তরে নানা প্রকার হতাশার কারণ তুলে ধরে, যেন আমরা আল্লাহর ওপর থেকে নিরাশ হয়ে পড়ি। অনেক সময় বলে ফেলি, যদি এটা আমার হতো বা আমি যদি তাদের মতো সম্পদশালী হতাম! আল্লাহ কেন আমাকে দারিদ্র্যে পতিত করলেন (নাউজুবিল্লাহ) ইত্যাদি শুধু অহেতুক প্রশ্ন আর চাওয়া-পাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিই। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, “নাকি তোমরা ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ এখনো তোমাদের নিকট তাদের মতো কিছু আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে বিগত হয়েছে। তাদের স্পর্শ করেছিল কষ্ট ও দুর্দশা এবং তারা কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসুল ও তার সাথি মুমিনরা বলছিল, ‘কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে?’ জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।” (সুরা বাকারা: ২১৪) যখন কারও ওপর দারিদ্র্যের পরীক্ষা নেমে আসে, তখন শয়তান দারিদ্র্যের বিভিন্ন প্রকার ভয় ও হতাশা চোখের সামনে তুলে ধরবে এবং নিরাশ করতে চাইবে আল্লাহর রহমত থেকে। এজন্য আল্লাহ উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘শয়তান তোমাদের দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং অশ্লীল কাজের আদেশ করে। আর আল্লাহ তোমাদের তার পক্ষ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা বাকারা: ২৬৮)। মনে রাখবেন, দারিদ্র্য একমাত্র আল্লাহ দিয়ে থাকেন এবং তিনিই প্রাচুর্যতা নিয়ে আসেন। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সঙ্গেই রয়েছে সুখ।’ (সুরা ইনশিরা: ৬) আল্লাহতায়ালা বলেন, দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমিই তোমাদের রিজিক দিই এবং তাদেরও। (সুরা আনআম: ১৫১)। সুতরাং, রিজিকের দায়িত্ব যেহেতু আমাদের হাতে নেই, তাহলে আমাদের ভয় পাওয়ারও কোনো কারণ নেই। সমাজের প্রতিটি স্তরে বাস করা দরিদ্রজন আজ অবহেলিত। দরিদ্র হলেই যেন ধনীদের চোখের কাঁটা। না আছে তাদের গুরুত্ব, না আছে মর্যাদা। এটা এমন এক অভিশাপে পরিণত হয়েছে যে, দরিদ্রজন মাথা উঁচু করে একটু কথা বলবে, সে সাহসখানিও পায় না। ধনীরা দরিদ্রদের পরিণত করে রেখেছে পূজনীয় পাত্রে। যখন দরিদ্রের কখনো কোনো হক কিংবা অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তখন তারা একটু অধিকার দাবিতে কথা বললেই যতসব বিপদ তাদের ওপর অর্পিত হওয়া শুরু করে; যেন সমাজ কিংবা দেশের আবর্জনা ছাড়া তারা কিছুই নয়। যখন রমজানে জাকাত দানের সময় উপস্থিত হয়, তখন দরিদ্রদের হাসির খোরাকে পরিণত করে থাকে। দরিদ্রদের কাছে জাকাত দানের নামে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে শাড়ি আর লুঙ্গি বিতরণ করা ঠাট্টা-বিদ্রুপাত্মক আচরণেও লিপ্ত থাকে। দান, সদকা, জাকাত ইত্যাদি সমাজে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখে। ধনীদের উচিত তাদের সঞ্চিত অর্থ-সম্পদের পূর্ণ জাকাত বের করে দরিদ্রের মধ্যে সঠিক উপায়ে বণ্টন করা এবং নিয়মিত দান-সদকা করা। দরিদ্রের সাহায্যে এগিয়ে আশা, তাদের দেখাশোনা করা, তাদের অসুস্থতায় পাশে দাঁড়ানো, তাদের প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া এবং তাদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা আমাদের একান্ত অপরিহার্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যদি সদকা প্রকাশ করো, তবে তা উত্তম। আর যদি তা গোপন করো এবং ফকিরদের দাও, তাহলে তাও তোমাদের জন্য উত্তম এবং তিনি তোমাদের গুনাহগুলো মুছে দেবেন। আর তোমরা যে আমল করো, আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত।’ (সুরা বাকারা: ২৭১)। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেট পুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে। (আদাবুল মুফরাদ: ১১২) অতএব প্রতিবেশী যারা অভাবগ্রস্ত থাকবে আমাদের উচিত সর্বাবস্থায় বিভিন্ন উপায়ে তাদের সহায়তা করা। আর কখনো দারিদ্র্যের পরীক্ষা নেমে এলে করণীয় হচ্ছে—আল্লাহর স্মরণ বাড়িয়ে দেওয়া, তওবা-ইস্তেগফার অধিক পরিমাণে করা, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া, ধৈর্যধারণ করা, সর্বাবস্থায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা, দারিদ্র্যের মাধ্যমে আল্লাহ পরীক্ষা নিচ্ছেন এই বিশ্বাস রাখা, পাপকাজ থেকে বিরত থাকা, দারিদ্র্য কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা। পাপে ডুবন্ত থাকলেও, মারাত্মক বিপদে অবস্থান করলেও, দারিদ্র্যের শিকার হলেও কিংবা যে অবস্থায় থাকুন না কেন; হতাশ হওয়া যাবে না। কারণ আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার কোনো অধিকার আমাদের নেই। আল্লাহতায়ালা আমাদের উপদেশ দিয়ে বলেন, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। (সুরা জুমার: ৫৩) দারিদ্র্য পার্থিব জীবনে কষ্টের কারণ হলেও পরকালের জীবনে আনন্দের কারণ। দারিদ্র্যের কারণে কোনো ব্যক্তি ধৈর্যধারণ করলে আল্লাহ তার মর্যাদা ধনীদের থেকেও অনেক বাড়িয়ে দেন। এ সম্পর্কে হজরত আনাস (রা.) হতে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। একদিন এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি দরিদ্রদের পক্ষ থেকে আপনার কাছে একটি কথা পৌঁছে দেওয়ার জন্য এসেছি। দরিদ্ররা বলে যে, সম্পদশালী ব্যক্তিরা তাদের ধনদৌলতের দ্বারা আমাদের থেকে অনেক অগ্রগামী। কারণ তাদের ধনদৌলত থাকার কারণে তারা হজ, দান প্রভৃতি ইবাদত করে আল্লাহর দরবারে অনেক উচ্চমর্যাদা অর্জন করেছে। আর আমরা তো এসব থেকে একেবারেই বঞ্চিত। রাসুল (সা.) বললেন, তুমি দরিদ্রদের কাছে আমার এই উপদেশ বাণীটি পৌঁছে দিও—যদি তোমরা ধৈর্যধারণ করো এবং আল্লাহতায়ালার কাছে এ অবস্থার বিনিময়ে সওয়াবের আশা রাখো, তাহলে তোমাদের জন্য বিশেষ পুরস্কার রয়েছে। যাতে সম্পদশালীদের কোনো অংশ নেই। আর সেই পুরস্কার হচ্ছে—এক. জান্নাতে লাল ইয়াকুত পাথরের তৈরি অট্টালিকা হবে। একমাত্র দরিদ্র নবী, দরিদ্র শহীদ এবং দরিদ্র মুমিন ছাড়া অন্য কেউ এতে প্রবেশ করতে পারবে না। দুই. দরিদ্র মুমিন ব্যক্তিরা, সম্পদশালী ব্যক্তিদের থেকে পাঁচশ বছর আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তাম্বিহুল গাফেলিন: ৯৯ পৃ.) প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিজে সম্পদশালী হলেও যেন দুর্বল, অসহায় দরিদ্র মানুষদের ভালোবাসে। কারণ দরিদ্রদের ভালোবাসার মধ্যে বিশ্ব প্রতিপালকের প্রিয়জনের ভালোবাসা নিহিত রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহতায়ালা রাসুল (সা.)-কে দরিদ্রদের ভালোবাসার ও তাদের সহচর্য গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বর্ণিত আছে, একদা উয়াইনা বিন হোসাইন ফাজারিসহ কয়েকজন স্বগত্রীয় প্রধান রাসুল (সা.)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে কিছু দরিদ্র অসহায় সাহাবিকে ময়লাযুক্ত কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখে রাসুল (সা.)-কে বললেন, হে মোহাম্মদ! আমাদের মর্যাদা উচ্চপর্যায়ের। সুতরাং আমাদের আগমনের সময় আপনি তাদের আমাদের সম্মানার্থে সরিয়ে দেবেন। এ বিষয়ে রাসুল (সা.)-এর মনে চিন্তার উদ্রেক হলে আল্লাহতায়ালা কোরআনের আয়াত নাজিল করে রাসুল (সা.)-কে সতর্ক করে দেন। তিনি যেন দুর্বল, অসহায়, দরিদ্র গরিব, সাহাবিদের তার মজলিস থেকে সরিয়ে না দেন। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে রাসুল!) আপনি তাদের বিতাড়িত করবেন না, যারা সকাল-বিকেল স্বীয় পালনকর্তার ইবাদত করে, তার সন্তুষ্টি কামনা করে। তাদের হিসাব বিন্দুমাত্রও আপনার দায়িত্বে নয় এবং আপনার হিসাব বিন্দুমাত্রও তাদের দায়িত্বে নয় যে, আপনি তাদের বিতাড়িত করবেন। নতুবা আপনি অবিচারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবেন।’ (সুরা আনয়াম: ৫২) আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে, যাদের দেখতে মনে হয় গরিব, দুর্বল, অসহায় কিন্তু তাদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে এতই বেশি যে, তারা কখনো কোনো বিষয়ে শপথ করলে আল্লাহ সেটা পূর্ণ করে দেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন কিছু মানুষ আছে যাদের মাথার চুল উশকোখুশকো, পা দুটো ধূলি-ধূসরিত, তাদের মানুষের দরজা থেকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়; কিন্তু তারা যদি আল্লাহর নামে কোনো শপথ করে, তাহলে আল্লাহতায়ালা তাদের শপথ অবশ্যই পরিপূর্ণ করেন।’ (মুসলিম: ৬৫৭৬)। সুতরাং আমাদের উচিত হলো, গরিব, দুর্বল, অসহায়, নিঃস্ব ব্যক্তিদের কখনো অবহেলার চোখে না দেখা। বরং তাদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া কর্তব্য। আল্লাহ সবাইকে তওফিক দিন। লেখক: ইমাম ও খতিব