ধান ভানতেও বিবিসির গীত: রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যর্থতা ঢাকার মিডিয়া কাব্য

১১ জুলাই, ২০২৫ | ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

সাধারণত যারা ৫ থেকে ১০ বছরের ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করেন, তাদের মাথায় তিনটি বিষয় রাখতেই হয়। প্রথমত, স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যের জন্য অপারেশনাল খরচ নিয়ন্ত্রণে রেখে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, মধ্যমেয়াদি লক্ষ্যের জন্য প্রাইসিং স্ট্র্যাটেজিকে সঠিকভাবে সমন্বয় করে লাভজনকতা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য পূরণের জন্য বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা যাচাই বা ফিজিবিলিটি অ্যানালাইসিস করা। এই তিনটি বিষয় বিশ্লেষণে আমরা সাধারণত তিনটি সূচক অনুসরণ করি এবং ট্রেন্ড বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যৎ অনুমান করার চেষ্টা করি। সেই তিনটি সূচক হলো: ১. দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, যাকে আমরা GDP বা মোট দেশজ উৎপাদন বলি। ২. দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সামগ্রিক অবস্থা। ৩. জনগণের ব্যয়যোগ্য আয় (ডিসপোজেবল ইনকাম) এবং মূল্যস্ফীতির হার। মাত্র দুই দিন আগে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ৩৫% শুল্ক আরোপ করেছে। এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাদের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে রপ্তানি খাত সংশ্লিষ্ট কাউকেই মিডিয়ায় মন্তব্য করতে দেখা যায়নি—শুধুমাত্র রুবানা হক ব্যতিক্রম। জনগণ যখন এ বিষয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখনই পরিকল্পিতভাবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিবিসি বাংলার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এটিই তো বাস্তব ‘মোমেন্টাম মার্কেটিং’। এগুলা হচ্ছে ইভ্যালির মত ধামাকা! সাময়িকভাবে ইভেক্টিভ কিন্তু সাস্টেইনেবল না। আপনি যদি নিজের চারপাশের মানুষদের নিয়ে একটি জরিপ করেন, দেখবেন—যেসব সাধারণ মানুষ কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে জড়িত নন এবং যাদের আয় প্রতি মাসে ছয় অঙ্ক বা তার বেশি—তাদের ১০ জনের ৭ জনই বিবিসির ঐ প্রতিবেদন দেখে যেন অদ্ভুত এক উত্তেজনায় অভিভূত হয়ে পড়েছেন। অন্যরা হয় বিষয়টিতে খুব একটা গুরুত্ব দেন না কিংবা জীবন সংগ্রামে এতটাই ডুবে আছেন যে এসব নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই। এর কারণ কী? কারণ, যাদের আয় ভালো, তাদের কিছু সঞ্চয় রয়েছে। সঞ্চয় থাকায় তাদের মধ্যে মানসিক ও আবেগিক স্বাধীনতা তৈরি হয়—রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করার মতো। কিন্তু বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৩০ লাখ, এর মধ্যে ছয় অঙ্কের মাসিক আয় হয় এমন মানুষের সংখ্যা কত? সর্বোচ্চ ২-৩ শতাংশ! আগামী ১লা আগস্ট থেকে যদি যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫% ভ্যাট কার্যকর হয়, তাহলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। আর এই খাত যদি ধসে যায়, তাহলে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা বা ডিপ্রেশন শুরু হবে। এর পরিণতিতে দেশে ভয়াবহভাবে বেড়ে যাবে সংঘবদ্ধ অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা। গত চার মাসে যখনই দেশে কোনো সংকট এসেছে, ঠিক তখনই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো না কোনো মিডিয়া প্রতিবেদন সামনে এসেছে—যেন সেই সংকটের বিষয়টি আড়াল করা যায়। এটি ছিল আওয়ামী লীগ সরকারেরই পুরোনো কৌশল। তবে পার্থক্য হলো—পূর্বের সরকারের হাতে যুক্তিসঙ্গত অনেক বিষয় ছিল। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে একমাত্র ‘ফ্যাসিস্ট’ তকমা কিংবা শেখ হাসিনাকেন্দ্রিক অপবাদ ছাড়া তেমন কিছু নেই। তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জনগণের সামনে ওই একই মূলা ঝোলানো হচ্ছে। একটু লক্ষ্য করলে দেখবেন, দেশে যখনই সংকট তৈরি হয়েছে, তখন তিনটি বিষয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে: ১. শেখ হাসিনা অথবা ফ্যাসিজম, ২. সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ (তার কোন না কোন কিছু ঘটে। এই ছেলেকে নিশ্চিতভাবে খুব হাই ডোজ ড্রাগের ওপর রাখা হয়, এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই), ৩. জুলাই মাস—জুলাই সনদ, জুলাই আন্দোলন বা জুলাই চেতনা ইত্যাদি। আপনি যদি গত ৬ মাসের সকল ঘটনা বিশ্লেষণ করেন, তবে এই বিষয়ের যথার্থতা খুঁজে পাবেন। আমি নিজে গত জুলাই মাসে যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের সময়কার একটি ভিডিও দেখেছি, গাজীপুরে র‍্যাবের গাড়িতে গাড়ির স্ট্যান্ডের সাথে র‌্যাব সদস্যের হাত বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে আন্দোলনকারীরা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। আন্দোলনের নামে এসব সহিংসতা আজকের নয়—প্রায় ১০ মাস আগে এই ঘটনা ঘটছে। তবে আমার কাছে আরও ভয়াবহ ভিডিও হচ্ছে— এক মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে বিবস্ত্র করে পিটিয়ে হত্যা করার দৃশ্য। অথবা মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায়, সালিশের পরদিন তিনজন মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে—এমন নিষ্ঠুরতা গত ১৫ বছরে দেখা যায়নি। একইভাবে, হঠাৎ করে দেশে মেয়েশিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। মাত্র গত ১৫ দিনের গণমাধ্যম বিশ্লেষণ করলেই দেখা যাবে: ১. কিশোরগঞ্জে ৭ বছর বয়সী এক শিশুকে নির্যাতন করে গাছে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২. সিলেটে গণধর্ষণের পর মৃত ভেবে এক কিশোরীকে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। ৩. মসজিদের ভেতরে ৮ বছর বয়সী ধর্ষিত শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৬ মাসে সংঘটিত সহিংসতার মধ্যে ৭০-৮০ শতাংশ ঘটেছে নারী ও মেয়েশিশুদের ওপর। ছেলে শিশুর মৃত্যুর খবর তেমন চোখে পড়ছে না। এর কারণ কী জানেন? কারণ, গত চার মাসে ২১ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে—এর মধ্যে ১৮ লাখই নারী। জানেন, এই বিষয়টি নিয়ে কয়টি মূলধারার সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন করেছে? কয়টি টকশো হয়েছে? কোনোটিই হয়নি—অথবা করতে দেওয়া হয়নি। কেন? কারণ, প্রথম আলো বা ডেইলি স্টার-এর মত প্রভাবশালী মিডিয়া হাউজকেও আজকাল সংবাদ এবং সংবাদের শিরোনাম পরিবর্তন করতে হয়। সংশোধন বা পরিমার্জন করতে হয়। কখনো কখনো সরিয়ে ফেলতে হয়। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে একটি লাইন ছিল— “বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ ক্ষমতা চায় না।” আপনি যদি মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে রেগুলার ৩০-৪০ মিনিট প্রাণ কোম্পানির সিইওর মতো অব্জার্ভেশনাল চোখ নিয়ে হেঁটে বেড়ান, পাড়ার চায়ের দোকান কিংবা বিকাশ-এজেন্টের দোকানে বসে থাকা মানুষগুলার কথা শোনেন, তাহলে খেয়াল করবেন—গণতন্ত্র, ভোটাধিকার নামক জিনিসগুলো নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা বা ঐসব দেশে থাকা NRB এবং মাঝে মধ্যে ঐসব দেশে বেড়াতে যাওয়া কিছু বাংলাদেশি ছাড়া কেউ চায় না কিংবা তাদের এ নিয়ে মাথাব্যথাও নাই। তাদের মাথাব্যথা চালের কেজি, মুরগির কেজি এবং ডিমের দাম নিয়ে। বাই দ্য ওয়ে, চালের কেজি কত চলছে এখন? পরিচিতি: গণমাধ্যমকর্মী