চীন গেল, জাপান এলো রেলপথের ব্যয় বাড়ল

২০১৫ সালে পরিকল্পনা, ২০২৭ সালে নির্মাণকাজ শুরুর টার্গেট—এক দশক পেরিয়েও জয়দেবপুর–ঈশ্বরদী রেলপথ প্রকল্প আজো মাঠে গড়ায়নি। সময় গড়িয়েছে, খরচ দ্বিগুণ ছাড়িয়ে গেছে, আর বারবার পরিবর্তিত হয়েছে অর্থায়নকারী রাষ্ট্র। আবার নতুন করে করা হচ্ছে সম্ভাব্যতা যাচাই, তৈরি হচ্ছে বিশদ নকশা। এই দীর্ঘসূত্রতা ব্যয় যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি প্রকল্প পরিচালনায় দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে বিশেষজ্ঞরা। ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদন পাওয়া এই প্রকল্পের ব্যয় প্রথমে ধরা হয় ১৪ হাজার ২৫০ কোটি ৬১ লাখ টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা ছিল চীনের, কিন্তু ২০২১ সালের মার্চে তারা অর্থায়ন থেকে সরে আসে। চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে প্রকল্পটি উপযুক্ত নয়।’ তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, প্রকল্প ব্যয় কমানোর নির্দেশই চীনকে সরে যেতে বাধ্য করে। এই ব্যাখ্যার পেছনে ভূরাজনৈতিক হিসাবও কাজ করেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামছুল হক, যিনি সেই সময়কার প্রকৌশল দলের সদস্য ছিলেন, বলেন: ‘চীনের সঙ্গে আমরা দর পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ তাদের সরিয়ে দিয়ে একপক্ষীয়ভাবে ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর চীনও সরে গেল। তখন থেকেই এটা রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পকে পরিকল্পিতভাবে হাতি বানানো হয়েছে। এভাবে একটি প্রকল্পের খরচ এত বাড়লে অন্যান্য উন্নয়ন উদ্যোগ থমকে যাবে।’ বর্তমানে প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা (JICA)। ২০২৪ সালের ২৭ জুন জাইকার সঙ্গে একটি অন্তর্বর্তী ঋণচুক্তিও হয়েছে। তবে এই চুক্তিতে জাইকা ঠিক কত টাকা দেবে, সেটি নির্ধারিত হয়নি। আপাতত ৭ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা ‘বুকিং মানি’ হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নির্মাণকাজ শুরুর সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছে ২০২৭ সালের জুলাই। প্রকল্পটি নিয়ে ২০১৫ সালে এডিবির অর্থায়নে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল, তবে সেটি এখন বাতিল করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জাইকা আবার নতুন করে সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে। এখন ১৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে বিস্তারিত নকশা, যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আরও গভীর সম্ভাব্যতা যাচাই। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন: ‘আগের সম্ভাব্যতা যাচাই এখন আরও বিস্তারিতভাবে করা হবে। ডিটেইল ডিজাইনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই হবে। এসব কারণেই নতুন করে ডিপিপি করতে হবে।’ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘সময় বাড়লে ব্যয় বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। আমরা আশাবাদী, জাইকার সঙ্গে ভালোভাবে কাজ করা যাবে। তবে আগের সম্ভাব্যতা যাচাই বা ডিপিপি কেন বাতিল হলো, সেটা আমি নিশ্চিত নই।’ বর্তমানে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার ৯৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা, যা আগে অনুমোদিত ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ। রেল মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন: ‘এই সময়ের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। পণ্যের দাম ও ডলারের দাম উভয়ই বেড়েছে। আগে এক ডলার ছিল ৮০ টাকা, এখন তা ১২২ টাকা। তাই ব্যয় বাড়াটা অস্বাভাবিক নয়।’ তিনি আরও জানান, প্রকল্পে একটি অতিরিক্ত রেলস্টেশন যুক্ত হওয়ায় ব্যয় আরও কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী রুটে রয়েছে একটি মাত্র রেললাইন, যার সর্বোচ্চ সক্ষমতা ২২টি ট্রেনের। কিন্তু বাস্তবে প্রতিদিন চলাচল করে প্রায় ৪০টি ট্রেন। ফলে বেশিরভাগ ট্রেনকেই রেলক্রসিংয়ে আটকে থাকতে হয়, যার ফলে সময়, জ্বালানি ও নিরাপত্তা—সবদিক থেকেই ক্ষতি হয়। নতুন এই ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মিত হলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তৈরি হবে ১৬২ কিমি নতুন রেললাইন, ১১ কিমি পুরাতন সংযুক্ত রেলপথ, ২৫ কিমি লুপ লাইন, মোট ১৯৮ কিমি রেলপথ, ২০৪টি রেলসেতু (৬৬টি বড় ও ১৩৮টি ছোট), ৩টি নতুন স্টেশন, ৭টি স্টেশন পুনর্নির্মাণ, ১৩টি স্টেশন সংস্কার, আধুনিক সিগন্যালিং ও লেভেলক্রসিং সিস্টেম। প্রকল্প নিয়ে জটিলতা ও দেরিতে ক্ষোভ জানিয়ে অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, ‘ব্যয় যেখানে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বেড়ে গেছে, সেখানে স্বচ্ছ ব্যাখ্যার দরকার। আর যদি পুরোনো সম্ভাব্যতা যাচাই ও ডিপিপি কার্যকর না হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—সেগুলো কেন করা হয়েছিল?’ দশ বছর আগে নেওয়া একটি উচ্চাভিলাষী রেল প্রকল্প এখনো শুধু কাগজে। সম্ভাব্যতা যাচাই, নকশা ও অর্থায়নের চক্রেই আটকে আছে এর অগ্রগতি। কাজ শুরুর পূর্বাভাস আবারও পেছালে শুধু ব্যয় নয়, উন্নয়নের বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নের মুখে পড়বে। এখন সময়ই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, সময়ানুগ পরিকল্পনা ও দক্ষ বাস্তবায়নের বিকল্প নেই—এটাই এখন দেশের পরিবহন অবকাঠামোর জন্য জরুরি বার্তা।