আমের বাজার ভালো না

শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট, গ্রামগঞ্জ– সবখানেই এখন আম আর আম। যেদিকে চোখ পড়ে, সেখানেই আম নিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। তবু আমের এই ভরা মৌসুমে সংকটে চাষিরা। ভালো ফলন হলেও তারা কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না। বাজারে চলছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, আছে কেনাবেচায় ওজন-সংক্রান্ত অনিয়ম। রপ্তানিতে নেই আশানুরূপ সাফল্য। ঈদের দীর্ঘ ছুটিসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে এখন আমের ভরা মৌসুম। চাষি পর্যায়ে এবার আমের দাম গত বছরের তুলনায় বেশ কম। যদিও রাজধানীর বাজারে আম বিক্রি হচ্ছে কেজি ৬০ থেকে ১০০ টাকা। তবে উৎপাদন এলাকাগুলোতে দাম ২০ থেকে ৩০ টাকার ওপরে উঠছে না। কোনো কোনো দিন মোকামে দাম ২০ টাকার নিচেও নেমে যাচ্ছে। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে চাষিদের। উৎপাদনে রেকর্ড, দাম তলানিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২ লাখ ২৫ হাজার ৩৪ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। এ বছর ২৭ লাখ ৩৫ হাজার টন আম উৎপাদনের প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। অনুকূল আবহাওয়ার কারণে আম উৎপাদনের পরিমাণ ২৮ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। মোট উৎপাদনের মধ্যে রাজশাহী বিভাগের চার জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরে প্রায় ১৩ লাখ ৫৫ হাজার টন আম উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষিসংশ্লিষ্টরা। এবার ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১৫ জুন থেকে আম্রপালি ও ফজলি, ৫ জুলাই থেকে বারি আম-৪, ১০ জুলাই থেকে আশ্বিনা, ১৫ জুলাই থেকে গৌড়মতী সংগ্রহ করা যাবে। এ ছাড়া কাটিমন ও বারি আম-১১ সারা বছরই পাকা সাপেক্ষ পাড়া যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত গরমে এবার একসঙ্গে সব জাতের আম পেকে গেছে। ঈদের ছুটিতে বাজারে আমের সরবরাহ হলেও পর্যাপ্ত ক্রেতা ছিল না। এতে বাজারে চাহিদা কমে দরপতন হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকা ও অন্য বড় শহরে চাহিদা কম থাকায় অনেক পাইকারই আমের চাষের এলাকায় যাননি। নওগাঁর সাপাহারের আম হাটে প্রতি মণ হিমসাগর ১৪০০-১৬০০ টাকা, ল্যাংড়া ১২০০-১৫০০, নাকফজলি ১৩০০-১৮০০, ব্যানানা ম্যাঙ্গো ৩৫০০-৪২০০, হাঁড়িভাঙা ১৫০০-২৫০০ এবং আম্রপালি ১৮০০-৩৫০০ টাকা মণ বিক্রি হয়। নওগাঁর সাপাহারের ওড়নপুর গ্রামের আমচাষি মাহমুদুর রহমান বলেন, এ বছর আমের দাম খুবই কম। গত বছর এই বাগানের আম প্রতি মণ বিক্রি করেছি ৪২০০-৪৫০০ টাকা। এবার বিক্রি করছি ২০০০-২৫০০ টাকা। যে দামে আম বিক্রি করলাম, তাতে খরচও উঠবে না। সাপাহার হাটে আম বিক্রি করতে আসা পত্নীতলার আমচাষি অজি উল্যাহ জানান, তিনি ১০ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে আম্রপালির বাগান করেছেন। দাম গত বছরের তুলনায় অর্ধেক। এটা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজি। নওগাঁর বদলগাছি এলাকার চাষি নুরুল ইসলাম বলেন, এ এলাকার বিখ্যাত ফজলি আমের মণ যাচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পাইকারি, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৬০০ টাকা কম। তিনি বলেন, এবার ঈদের কারণে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। লম্বা ছুটিতে শহরের মানুষ গ্রামে থেকেছে। ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহর এলাকায় আম পাঠানো যায়নি, চাহিদাও ছিল না। তখন আম পেকেছে, নষ্ট হওয়ার ভয়ে কম দামে বিক্রি করেছি। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট বাজারে মৌসুমের শেষদিকে হিমসাগরের দাম কিছুটা বেড়েছে। মণপ্রতি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে এই জিআই পণ্য। চাষিরা বলছেন, সরবরাহ কমে যাওয়ায় শেষদিকে দাম বাড়লেও তা লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার মতো নয়। সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবে উপেক্ষিত নওগাঁর সাপাহার, রাজশাহীর বানেশ্বর বা চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট– সব বাজারেই কেজি দরে আম কেনাবেচার সিদ্ধান্ত থাকলেও ব্যবসায়ীরা তা মানছেন না। আমচাষিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল কেজি দরে আম কেনাবেচার। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন রাজশাহী বিভাগীয় পর্যায়ে কেজি দরে আম কেনাবেচা নিয়ে উপজেলা প্রশাসন, ব্যবসায়ী, আড়তদার ও চাষিদের মাঝে আলোচনা হয়। কেজি দরে আম বিক্রির সিদ্ধান্ত হলেও প্রশাসনের নিয়ম মানা হচ্ছে না। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন চাষিরা। তাদের অভিযোগ, এখনও ৫০-৫২ কেজিকে মণ ধরা হচ্ছে। এতে কম দামে বেশি আম যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের ঝুলিতে। নওগাঁর সাপাহারের আমচাষি আজিম উদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে ৫০ থেকে ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম কিনছেন। তবে এটা ঠিক নয়। এ বিষয়ে প্রশাসনের নজরাদারি বাড়ানো দরকার। চাঁপাইনবাগঞ্জের কানসাট থেকে আসা আম ব্যবসায়ী আতিকুর রহমান বলেন, আমরা কৃষকদের সঙ্গে আলোচনা করেই ৫০ থেকে ৫২ কেজিতে মণ ধার্য করেছি। এর কারণ হলো ক্যারেটের সব আম এক সাইজের হয় না। নওগাঁর জেলা প্রশাসক আবদুল আউয়াল বলেন, কেজি দরে আম কেনাবেচা করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক মাইকিং করা হচ্ছে। কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য আবার ব্যবসায়ী, আড়তদার ও আমচাষিদের নিয়ে আলোচনা করা হবে। তার পরও এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রপ্তানিতে সংকট বিশ্বে আম উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম হলেও রপ্তানিতে সেই ধার নেই। চলতি মৌসুমে চীনসহ ৩৮টি দেশে ৫ হাজার টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও এখন পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭৮০ টন। রপ্তানি হোঁচট খাচ্ছে নানা জটিলতায়। রাজশাহী অঞ্চলে নেই হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা প্যাকিং হাউজ। এসব না থাকায় ঢাকায় আম নিয়ে গিয়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়, এতে ১০ শতাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। ফিটোস্যানিটারি সনদ জটিলতা, কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়া ও অধিক বিমান ভাড়াও বড় প্রতিবন্ধকতা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, উত্তম কৃষি চর্চা পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করতে চাষিদের বাড়তি খরচ হয়, কিন্তু তারা সে অনুযায়ী সুফল পাচ্ছেন না। রাজ-চাঁপাই এগ্রো ফুড প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আনোয়ারুল হক বলেন, রাজশাহীতে প্যাকেজিং হাউস স্থাপনের দাবি ১০ বছর ধরে জানিয়ে আসছি। সরকার আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কিছুই হয় না। আগে আমাদের সংগঠনে সদস্য বেশি ছিল, কিন্তু রপ্তানি জটিলতায় অনেকেই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চাষিদের ন্যায্য দাম নিশ্চিতে প্রশাসনিক তদারকি, রপ্তানি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ করতে হবে। না হলে চাষিদের আস্থা হারাবে ফল উৎপাদন, হোঁচট খাবে আম রপ্তানির সম্ভাবনা। রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, চলতি বছর পাঁচ হাজার টন আম রপ্তানির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল। এখনও আরও দুই মাস সময় আছে। এ বছর থেকে চীনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের আম রপ্তানি শুরু হয়েছে। রপ্তানিযোগ্য আম শুধু বিদেশ নয়, দেশের সুপারশপেও বিক্রি হচ্ছে। আমরা মাঠে থেকে কৃষকদের পাশে আছি। তিনি আরও বলেন, আম রপ্তানির ক্ষেত্রে দুই-তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিমান ভাড়া যদি স্থিতিশীল থাকে ও বিমানের যদি সংকট না হয়, তাহলে আরও বড় পরিসরে আম রপ্তানি করা যাবে। এ বিষয়টি নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় কাজ করছে।