ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নই প্রধান সমস্যা

সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট ঘোষণা করেছে। রাজস্ব বাজেটকে ব্যালান্সড বাজেট হিসেবে দেখানো হলেও সার্বিক আয়-ব্যয়কে ঘাটতি বাজেট হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যার বিপরীতে পরিচালনা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এককথায় আগামী বছরের জন্য প্রাক্কলিত আয়-ব্যয় সমান, যা মূলত ব্যালান্সড বাজেটের বৈশিষ্ট্য বহন করে। এদিকে মোট বাজেটের পরিমাণ হচ্ছে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে উন্নয়ন বাজেটের পরিমাণ দুই লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। মোট বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই ঘাটতি। আমাদের দেশে ঘাটতি বাজেট নতুন কিছু নয়। অতীতেও সব সময় ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় এবারও ঘাটতি বাজেট প্রণীত হবে এটাই স্বাভাবিক এবং হয়েছেও তাই। কিন্তু অতীতের বাজেটের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের একটা বিশেষ বৈসাদৃশ্য আছে। বিগত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার সময় দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের অগ্রগতির ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। বাজেট ঘোষণায় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বিগত বছরের থেকে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। এবার দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে মন্দা অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় আছে চরম অনিশ্চয়তা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে। এমনকি সরকারও জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা বিগত বছরের তুলনায় বেশ কম নির্ধারণ করেছে। এর ফলে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা যে অর্জিত হবে এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এমনিতেই আমাদের দেশে বাজেটে নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দৃষ্টান্ত নেই। প্রতিবছরই বাজেটে উল্লিখিত রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকে। এই যেখানে অবস্থা, সেখানে যদি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করে তখন রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আর তেমনটা হলে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পাবে। https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/06.June/18-06-2025/kalerkantho-ed-1a.jpgধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে ঘাটতি বাজেট মোটেই কোনো সমস্যা নয়, বরং একধরনের নতুন বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বের বেশির ভাগ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এই ঘাটতি বাজেট অনুসরণ করে থাকে। ঘাটতি বাজেটের মূলকথা হচ্ছে, আগে ঋণ নিয়ে উন্নতি করে পরে সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করা। এর বিকল্প হতে পারে আগে অর্থ সঞ্চয় করে সেই অর্থ দিয়ে উন্নতি করা। দ্বিতীয় পদ্ধতি বেশি যুক্তিসংগত হলেও বাস্তবে হয়ে ওঠে না। ফলে উন্নত বিশ্বসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ প্রথমোক্ত পদক্ষেপই অনুসরণ করে থাকে। ঘাটতি বাজেট ফলপ্রসূ হয় তখনই, যখন বাজেটের ঘাটতি সঠিকভাবে অর্থায়ন করা সম্ভব হয়। পক্ষান্তরে ঘাটতি বাজেট মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে যদি বাজেটের ঘাটতি সঠিকভাবে অর্থায়ন করা সম্ভব না হয়। যেমন—যদি উচ্চ সুদের হারে ঋণ নিয়ে বা নিয়মিত বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের উৎস না থাকা সত্ত্বেও বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে ঘাটতি বাজেটে অর্থায়ন করা হয়, তখন সেই ঘাটতি বাজেট ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতির এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। এর বড় একটি অংশ আবার সংগ্রহ করা হবে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে। বাকি এক লাখ এক হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে সংগ্রহ করা হবে। যে পদ্ধতিতে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়নের কথা বলা হয়েছে, তা মোটেই সুবিধাজনক হতে পারে না। প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস, বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি এবং ব্যাংকঋণের মাধ্যমে যে অর্থ সংগ্রহ করা হয় তার ওপর অতি উচ্চ হারে সুদ প্রদান করতে হয়। এমনিতেই সরকারকে বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রতিবছর ঋণের সুদ হিসেবে ব্যয় করতে হয়। প্রস্তাবিত বাজেটে যে পরিচালনা ব্যয় ধরা হয়েছে তার মধ্যে ঋণের ওপর প্রদত্ত সুদের পরিমাণ এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এই পরিমাণ সুদ যে বিশাল অঙ্কের ঋণের জন্য দিতে হয় তেমন নয়, বরং ঋণের ওপর উচ্চ সুদের কারণে সুদের পরিমাণ এত বেশি। তা ছাড়া সরকার যদি ঘাটতি বাজেটে অর্থায়নের জন্য বিশাল অঙ্কের ঋণ দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে সংগ্রহ করে, তাহলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণও অনেক বেশি ধরা হয়েছে। আমাদের দেশে সরকারি ঋণের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হয়ে গেছে। যদিও জিডিপি এবং ঋণ অনুপাতের যে সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য সীমারেখা, তা থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ নিচেই আছে। কিন্তু ঋণ গ্রহণের উৎস, ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং ঋণ পরিশোধ বা ডেট সার্ভিসিং সক্ষমতার দিক থেকে অনেক বেশি হয়ে গেছে। প্রায় দুই বছর আগে এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬.৫০ বিলিয়ন ডলার। একই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সরকারি-বেসরকারি মিলে মোট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছিল ৯৯.৩০ বিলিয়ন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত ‘মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি’ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হবে ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ সালে ছিল ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ সালে ছিল ৯ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। সেই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছিল যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের আসল বাবদ ২.৬৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদন থেকে এটা পরিষ্কার যে প্রতিবছর ঋণের প্রদেয় সুদ এবং আসল পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এটাই স্বাভাবিক। কেননা ঋণের পরিমাণ যত বৃদ্ধি পাবে এবং ঋণ যত পুরনো হবে, ততই ঋণের সুদের পাশাপাশি আসল পরিশোধের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে ক্রমাগত ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, ঋণ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া এবং সর্বোপরি ঋণের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এই অবস্থা দেশকে ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে দিতে পারে, যেখান থেকে খুব সহজে বের হওয়া যাবে না। বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যমটা মোটেই স্থিতিশীল নয়। আমাদের আমদানির চেয়ে রপ্তানি যথেষ্ট কম। এই ঘাটতি মেটানোর জন্য নির্ভর করতে হয় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর। সার্বভৌম বা রাষ্ট্রীয় ঋণ নয়, যেকোনো ঋণের ক্ষেত্রেই দুটো বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার একটি হচ্ছে ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা এবং আরেকটি হচ্ছে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা, যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় ডেট সার্ভিসিং বলা হয়ে থাকে। আমাদের দেশ বর্তমানে ঋণ গ্রহণের সক্ষমতা কতটুকু আছে তা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ঋণ, বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতার অভাব তো আছেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবস্থায় ঘাটতি বাজেটে অর্থায়নের ব্যবস্থা কী হতে পারে। এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর আমার জানা নেই। তা ছাড়া কাজটাও বেশ দুরূহ, তবে চেষ্টা থাকতে হবে এবং ঘাটতি বাজেটে অর্থ সংগ্রহের যে উৎস দেখানো হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কমিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। যতটুকু না হলেই নয়, ঠিক ততটুকু বৈদেশিক ঋণ নেওয়া যেতে পারে। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে আসতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ঋণের উৎস ব্যাংকিং খাত থেকে সরিয়ে বন্ড মার্কেটের দিকে যেতে হবে। এতে যুগপৎ দুটো লাভ হবে। বন্ড মার্কেটে সুদের হার কম এবং সরকার বন্ড মার্কেট থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বিঘ্নিত হবে না। সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে সেকেন্ডারি বন্ড মার্কেট নেই। এই বন্ড মার্কেট গড়ে তুলতে হবে। তবে বন্ড মার্কেট গড়ে না ওঠা পর্যন্ত সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ট্রেজারি বন্ড এবং অন্যান্য সার্বভৌম বন্ড বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। মোটকথা ঘাটতি বাজেট সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে কিভাবে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন হবে। নিরঞ্জন রায় লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা Nironjankumar_roy@yahoo.com