রাজস্ব স্থবির, উৎপাদন মুখ থুবড়ে: সংকটে দেশের অর্থনীতি

মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই দেশের অর্থনীতি এক গভীর অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে, শিল্প খাত স্থবির, বাড়ছে বেকারত্ব; অন্যদিকে বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা একে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিম্নগামী, কর্মসংস্থান তলানিতে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে যেতে পারে মাত্র ৩.৩ শতাংশে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইতোমধ্যেই দেশের প্রধান শিল্প অঞ্চলে (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ-নরসিংদী, সাভার-ধামরাই) শতাধিক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। শিল্প পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, এ কারণে বেকার হয়েছেন অন্তত ৬০ হাজার শ্রমিক। তবে আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ মাসে মোট ২১ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে ১৮ লাখই নারী। বিশ্বব্যাংক জানায়, নতুন করে ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কবলে পড়তে পারেন। বিনিয়োগ স্থবির, ব্যাংক দুর্বল অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই বৈদেশিক বিনিয়োগ কমেছে ৭০ শতাংশ। বেসরকারি খাতে অর্থপ্রবাহও বিপর্যস্ত। ব্যাংকগুলো চড়া সুদ (১৬ শতাংশ পর্যন্ত) সত্ত্বেও নতুন ঋণ দিতে পারছে না। দেশের বহু ব্যাংক বর্তমানে মূলধন সংকটে ভুগছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক আশরাফ আহমদ বলেন, “ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ীদের সহায়তা করতে পারছে না, ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। মালিকদের কাছে টাকা নেই, শ্রমিকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। এর ফল হলো—অর্থনীতির অরাজকতা।” জ্বালানিতে চরম অনিশ্চয়তা শিল্প খাতের আরেক বড় সমস্যা হলো জ্বালানির ঘাটতি। গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় অনেক কারখানা উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। সরকার আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে চাইলেও তা দীর্ঘমেয়াদে সংকট সমাধানে যথেষ্ট নয়। পেট্রোবাংলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বঙ্গোপসাগরের ২৬টি ব্লকে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বিদেশি কোম্পানিগুলোর অনাগ্রহের কারণে নতুন চুক্তি হয়নি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচনপূর্ব অনিশ্চিত পরিস্থিতিকে এর জন্য দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “দেশে রাজনৈতিক স্থিতি না ফিরলে অর্থনীতির এই ধ্বস ঠেকানো যাবে না। বিনিয়োগকারীরা নির্বাচন ও সরকার কাঠামো নিয়ে নিশ্চিত না হলে নতুন অর্থ ঢুকবে না।” তাঁর মতে, সরকারের উচিত দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো। রিজার্ভ কমছে কেন? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১০ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শুরুতে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২১ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে চলতি বছরের ১৫ জুন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, রিজার্ভ কমেছে ০.৮২ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮২ কোটি ডলার। অথচ এই সময়েই রেমিট্যান্স ও রফতানি খাতে এসেছে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি—প্রবাসী আয় বেড়েছে প্রায় ২৪.৫ শতাংশ এবং রফতানি আয় বেড়েছে ১০ শতাংশ। মাত্র ১১ মাসে এই দুই উৎস থেকে এসেছে অতিরিক্ত ৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) বিশ্লেষণ বলছে, বড় ধরনের ঋণ পরিশোধ, বিদেশি বিনিয়োগ, অনুদান ও ঋণপ্রবাহে স্থবিরতা এই ঘাটতির প্রধান কারণ। গত ১০ মাসে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ৩৭ কোটি ডলার, বিদেশি অনুদান কমেছে ১৮৬ কোটি ডলার এবং মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ কমেছে ১৩৬ কোটি ডলার। শুধু এই তিন খাত থেকেই আগের বছরের তুলনায় কম এসেছে ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। এই সময় আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার এবং আগের বছরের জমে থাকা বৈদেশিক ঋণ, সেবা ব্যয় ও এলসি পরিশোধেও রিজার্ভ থেকে ব্যয় হয়েছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, এই সময়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ঋণ সহায়তা না আসায় রিজার্ভে প্রত্যাশিত পুনরুদ্ধার ঘটেনি। তবে তিনি জানান, জুন মাসেই আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার কাছ থেকে সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অর্থ এলে রিজার্ভে খানিকটা উন্নতি হতে পারে।