চট্টগ্রাম বন্দরে ঈদের ছুটিতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস

১৩ জুন, ২০২৫ | ১০:৪৭ পূর্বাহ্ণ
ডেস্ক নিউজ , ডোনেট বাংলাদেশ

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে লম্বা ছুটির কারণে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ডেলিভারি কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া শ্রমিক সংকটের কারণে জাহাজে কনটেইনার ওঠানামায়ও সময় লাগছে বেশি। এতে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ধস নেমেছে। অন্যদিকে একই সংকটের ফলে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোগুলো (আইসিডি) থেকে সঠিক সময়ে রপ্তানি পণ্য বন্দরে না আসায় রপ্তানি পণ্য সময়মতো জাহাজে ওঠানো যায়নি বলে জানিয়েছেন টার্মিনাল অপারেটর ও বার্থ অপারেটররা। ফলে রপ্তানি শিপমেন্টের শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ছুটিতে জাহাজ থেকে আমদানি পণ্য খালাস এবং বন্দর থেকে রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণ কমে যাওয়ায় বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়েছে। ঈদের ছুটির আগে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমসের যৌথ সভায় বন্দর সচল রাখতে নেওয়া হয়েছিল ১০টি সিদ্ধান্ত। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব সিদ্ধান্তের সুফল আসেনি। উল্টো বন্দরের বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বৃদ্ধির ফলে তাদের ক্ষতি বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ঈদের ১০ দিন ছুটির সময়ের স্টোরেজ ভাড়া মওকুফের দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদের ছুটিতে গত ৯ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫টিতে। এর মধ্যে কনটেইনার জাহাজই ২৪টি। এর আগে গত ৪ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আমদানি পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষায় ছিল ১৭টি কনটেইনার জাহাজ। একই সময় স্ক্র্যাপসহ অন্যান্য আমদানি পণ্য নিয়ে অপেক্ষায় ছিল আরও ৯টি জাহাজ। স্বাভাবিক সময়ে এভাবে কনটেইনারসহ বিভিন্ন ধরনের ২৫ থেকে ২৬টি জাহাজ বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ থাকলেও ঈদের ছুটিতে এ সংখ্যা বেড়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের পোর্ট পারফরম্যান্স রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ জুন বন্দরের ১২টি কনটেইনার জেটির মধ্যে মাত্র ৫টি জেটিতে থাকা কনটেইনার জাহাজে কাজ হয়েছে। ওইদিন বন্দর থেকে মাত্র ১৩১টি কনটেইনার জাহাজীকরণ হয়। অন্যদিকে একই সময়ে জাহাজ থেকে আমদানি পণ্যভর্তি কনটেইনার খালাস হয় মাত্র ৩০৮টি। এদিকে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কমে যাওয়ায় বন্দরের বহির্নোঙরে ওয়ার্কেবল অপেক্ষমাণ জাহাজ বাড়ছে। ১০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ওয়ার্কেবল অপেক্ষমাণ জাহাজ রয়েছে ৫৩টি। এর মধ্যে কনটেইনার জাহাজ ১৬টি, জেনারেল কার্গো জাহাজ ১৫টি, ফুড গ্রেইন বোঝাই জাহাজ ৬টি, ক্লিংকারবাহী জাহাজ ২টি এবং অয়েল ট্যাঙ্কার ৭টি। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঈদের ছুটি চলাকালে অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে কনটেইনার ডেলিভারির সংখ্যা। ৫ জুন বন্দরে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল ৪ হাজার ১২২ টিইইউস (বিশ-ফুট সমতুল্য ইউনিট)। এদিন জাহাজে কনটেইনার ওঠানামা বা হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৯ হাজার ৭২০ টিইইউস, আর আমদানি কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়েছিল ৫ হাজার ৪১১ টিইইউস। কিন্তু এরপর থেকে বন্দরে কমতে থাকে ডেলিভারির সংখ্যা। ৬ জুন ৩ হাজার ৫০৫ টিইইউস, ৭ জুন ৫২১ টিইইউস, ৮ জুন শূন্য টিইইউস, ৯ জুন ৪৩৭ টিইইউস ও ১০ জুন ১ হাজার ৩৮১ টিইইউস কনটেইনার ডেলিভারি করা হয়েছে। ঈদের ছুটিতে কমে গেছে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও আমদানি কনটেইনার নামানোর সংখ্যাও। স্বাভাবিক সময়ে জাহাজ থেকে প্রায় ৫ হাজার আমদানি কনটেইনার নামানো হয়। কিন্তু ৬ জুন ৫ হাজার ৫৪৪ টিইইউস, ৭ জুন ২ হাজার ৮৩৫ টিইইউস, ৮ জুন ৩০৮ টিইইউস, ৯ জুন ২ হাজার ১১৩ টিইইউস ও ১০ জুন জাহাজ থেকে নামানো হয় ২ হাজার ৩১১ টিইইউস আমদানি কনটেইনার। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮টি কনটেইনার, যার সর্বোত্তম পরিচালনা ক্ষমতা ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টিইইউস। ১০ জুন পর্যন্ত বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার ছিল ৩৮ হাজার ৫২ টিইইউস। আর বুধবার পর্যন্ত বন্দরে ৪০ হাজার ৬৬১ টিইইউস কনটেইনার ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র চিফ পারসোনাল অফিসার নাসির উদ্দিন বলেন, বন্দরে সব ধরনের কার্যক্রম চালু আছে। কনটেইনার ডেলিভারি দেওয়ারও সব প্রস্তুতি আছে বন্দর কর্তৃপক্ষের। বন্দর কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য ক্যাপ্টেন আহমেদ আমিন আব্দুল্লাহ বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বন্দরের বহির্নোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যা একটু বেশি। সাধারণত দিনে ১০ থেকে ১৫টি জাহাজ চলে এলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে এখন বহির্নোঙরে জাহাজের যে সংখ্যা, তা নিয়ে আশঙ্কার কিছু নেই। যে ফ্লোতে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস হচ্ছে তাতে জট তৈরির সুযোগও কম। কয়েকদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে। বিজিএমইএর নবনির্বাচিত কমিটির পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘বন্দরে ডেলিভারির অপেক্ষায় থাকা কনটেইনারের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়া মানেই অ্যালার্মিং। এখন কোনো কারণে দু-এক দিন কনটেইনার ডেলিভারি কম হলে বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হবে। জট যাতে না হয়, সেজন্য সংশ্লিষ্টদের তৎপর থাকতে হবে। জট তৈরি হলে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হব।’ আইসিডি মালিকদের সংগঠন বিকডার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে ২ হাজার ২০০ টিইইউস রপ্তানি কনটেইনার জাহাজে তোলা হয়। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে কনটেইনার বোঝাই করা যায়নি। ফলে অন্তত ৩০ শতাংশ রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার জাহাজে সঠিক সময়ে তোলা যায়নি। জাহাজে পণ্য লোড ও আনলোড করার সময়ও বেড়েছে। বন্দর জেটিতে জাহাজ প্রবেশ করে কনটেইনার লোড-আনলোড করতে সময় লাগে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা। ঈদের ছুটিতে শ্রমিক কমে যাওয়ায় ও কনটেইনার জট তৈরি হওয়ায় এখন সময় লাগছে ৭২ থেকে ৯৬ ঘণ্টা। তবে দু-এক দিনের মধ্যে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের ১২টি কনটেইনার জেটির মধ্যে এনসিটি ও সিসিটিতে ছয়টি জেটি পরিচালনা করে সাইফ পাওয়ারটেক। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক নাজমুল হক বলেন, সঠিক সময়ে বন্দর ইয়ার্ডে কনটেইনার না পৌঁছায় রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার শিডিউল অনুযায়ী জাহাজে ওঠানো সম্ভব হয়নি। শিডিউল বিপর্যয়ে পড়া এসব কনটেইনার প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর পরবর্তী জাহাজে ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ১০ মার্চ থেকে বিদ্যমান স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বাড়িয়েছে। জাহাজ থেকে নামানোর পর চার দিনের বেশি বন্দরে থাকা কনটেইনারের ক্ষেত্রে এ বর্ধিত চার্জ প্রযোজ্য হয়। রমজান মাসে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট রোধ করতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকে স্টেকহোল্ডাররা এই চার্জ বাতিলের দাবি জানিয়ে এলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেনি। বিকেএমইএর পরিচালক সামছুল আজম বলেন, চার দিনের ফ্রি টাইমের পর প্রথম সাত দিনের জন্য একটি ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ৬ ডলার চার্জ করা হয়, আর ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য ১২ ডলার খরচ হয়। এ চার্জ ধীরে ধীরে বাড়ে—তৃতীয় সপ্তাহে ২০ ফুট ও ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য যথাক্রমে ২৪ ডলার ও ৪৮ ডলার চার্জ দিতে হয়। নতুন আরোপিত চারগুণ ফি অনুসারে, আমদানিকারকদের ২০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ২৪ থেকে ৯৬ ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের জন্য প্রতিদিন ৪৮ থেকে ১৯২ ডলার দিতে হচ্ছে। চারগুণ স্টোরেজ রেন্টের কারণে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ছাড় করতে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। পোশাক শিল্পের বর্তমান সংকটকালীন সময়ে এ সিদ্ধান্ত দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিত। চট্টগ্রাম গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও বাংলাদেশ ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ বেলাল বলেন, ‘জাহাজে পণ্য ওঠানামায় বিলম্বের কারণে এক দিন বেশি সময়ের জন্য জাহাজের আকারভেদে ১৫ হাজার ডলার থেকে ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হবে। এ বাড়তি খরচ যুক্ত হবে পণ্যের মূল্যে। ঈদের সরকারি ছুটি কোনোভাবেই পাঁচ দিনের বেশি হওয়া উচিত ছিল না। টানা ছুটির প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে বন্দরের কার্যক্রমে। চারগুণ স্টোর রেন্ট চাপিয়ে দেওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। আমরা স্টোর রেন্ট মওকুফের জন্য এরই মধ্যে একাধিকবার চিঠি দিয়েছি।’